রুমা ও আলীকদমে স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের উপর সেনাবাহিনীর মধ্যযুগীয় শোষণ-নির্যাতন

0
1315
ছবিতে জুম্ম গ্রামবাসীদের কর্তৃক সেনা ক্যাম্পে কাজ করার দৃশ্য এবং জনৈক সেনা কম্যান্ডারের চিঠি

হিল ভয়েস, ৩১ জুলাই ২০২১, বান্দরবান: সম্প্রতি বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন রুমা ও আলীকদম উপজেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসী জুম্ম গ্রামবাসীদেরকে জোরপূর্বক বিনাপারিশ্রমিকে কাজে বাধ্য করাসহ মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণ-নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি হিল ভয়েস কর্তৃক পরিচালিত এক তদন্তে রুমা উপজেলার রুমা বাজার সেনা ক্যাম্প ও আলীকদম উপজেলার বুলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় মারমা ও ম্রোদের উপর অজানা ও সীমাহীন নির্যাতন ও শোষণ চাপিয়ে দেওয়ার কাহিনীর কথা জানা গেছে।

জানা গেছে, উক্ত সেনা ক্যাম্পের সেনাবাহিনী দীর্ঘ দিন যাবৎ স্থানীয় জুম্মদের তাদের ক্যাম্পে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য করা, ন্যায্যমূল্য না দিয়ে স্থানীয় জুম্মদের দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করা এবং বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিভিন্ন জিনিসি ক্যাম্পে দিতে বাধ্য করার মত মানবাধিকার লংঘন করে চলেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জুলাই ২০২১ সেনাবাহিনীর শাশ্বত ২৭ ইস্ট বেঙ্গল এর ২নং রুমা বাজার সেনা ক্যাম্পের জনৈক ক্যাম্প কম্যান্ডার রুমা উপজেলার লুংঝিড়ি পাড়ার কার্বারি শৈহ্লাউ মারমাকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যান। এসময় ক্যাম্প কম্যান্ডার বলেন, তাদের ক্যাম্পের আশেপাশে জঙ্গলে ভরে গেছে। এই জঙ্গল দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে। এরপর ক্যাম্প কম্যান্ডার কার্বারি শৈহ্লাউ মারমাকে হাতি মাথা পাড়া, পলিপাড়া গ্রামের লোকজনদের দিয়ে অবিলম্বে জঙ্গল পরিষ্কার কড়া নির্দেশ দেন।

ক্যাম্প কম্যান্ডার সেই সাথে আরও বলেন, যতদিন জঙ্গল সম্পূর্ণ পরিষ্কার হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত কাজ করতে হবে। তার জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। এটাই ক্যাম্প কম্যান্ডারের আদেশ বলে তিনি তার কক্ষে ঢুকে যান।

এরপর কার্বারি শৈহ্লাউ মারমা দুপুরে বাড়িতে ফিরে এসে হাতি মাথা পাড়া ও পলি পাড়ার দুই কার্বারিকে ডেকে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও পরের দিন সকালে গিয়ে ক্যাম্পের আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করাসহ পারিশ্রমিক না দেয়ার ব্যাপারে ক্যাম্প কমান্ডারের নির্দেশনা জানিয়ে দেন।

নির্দেশের চাপে গত ২৭ জুলাই ২০২১ সকালে দুই কার্বারি নিজ নিজ গ্রাম থেকে ২০ জন করে ৪০ জন মারমা গ্রামবাসীকে ক্যাম্প পরিষ্কার করার জন্য ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। সারাদিন কাজ করে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই সেনাবাহিনী বিকালে গ্রামবাসীদের পাঠিয়ে দেয়।

শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম এলে গ্রামবাসীদের দিয়ে জোর করে বিনাপয়সায় ক্যাম্পের আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করানো হয় এবং তাদের চাহিদা মোতাবেক গ্রাম থেকে প্রাপ্য মূল্য না দিয়ে গ্রামবাসীদের হাঁস-মুরগি, ছাগলসহ অনেক দ্রব্য জোর করে নিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় গ্রামবাসী বলেন, আমরা নিরুপায় মানুষ। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না। তারা যা চাইবে, তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে হয়, না হলে আমাদের উপর নানাভাবে অত্যাচার চালায়।

জানা গেছে, সম্প্রতি রুমা বাজার সেনা ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর নতুন দল বদলি হয়ে আসে। সেকারণে এখনও ক্যাম্প কম্যান্ডারের নাম জানাতে পারেননি গ্রামবাসীরা।

অন্যদিকে আলীকদম উপজেলায়ও সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় ম্রোদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের খবর পাওয়া যায়।

জানা গেছে, গত কয়েক মাস আগে আলীকদম সেনা জোনের অধীনস্থ ২৩ বীর বুলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের জনৈক কমান্ডার তার স্বাক্ষর ও সীল সম্বলিত একটি চিঠি উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের মাওরুম (মাংরুম) পাড়ার কার্বারিকে প্রেরণ করেন। কম্যান্ডার চিঠিতে লেখেন, “মাওরুম কার্বারি আমি ক্যাম্প কমান্ডার বলছি। আমাদের রান্না করে খাওয়ার কোন লাকড়ি নাই, যা আছে ভিজা। আগামীকাল আমাদের উৎসব, রান্না করা লাগবে। তুমি ১০ বোঝা লাকড়ি পাঠাবে আগামীকাল সকালে সমবং পাড়া ও মেনলিউ পাড়া থেকে। তাছাড়া আমাদের রান্না হবে না।” উক্ত চিঠি হিল ভয়েসের কাছে এসে পৌঁছেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, প্রতি বছর অথবা মাসে বলাই পাড়া সেনাক্যাম্পের সেনাবাহিনী কর্তৃক বুলাই পাড়া, ইয়ংচা পাড়া, সমবং পাড়া ও মেনলিউ পাড়া গ্রামবাসীদের বিনা পারিশ্রমিকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়। এছাড়াও বিগত কোরবানির ঈদের আগে বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্প থেকে উক্ত চার গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের গরু লাগবে, গ্রামবাসীরা যেন তাদের গরু কিনে দেয়। গরু পাওয়ার পর টাকা দেয়া হবে।

সেনাবাহিনীর এই নির্দেশের পর গ্রামবাসীরা অনেক কষ্টে ২৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে বাজার থেকে গরু ক্রয় করে। ক্রয়কৃত গরু সেনা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হলে ক্যাম্পের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। শুধু গরু নয়, বলাই পাড়ার সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা যখন যা চাইবে গ্রামবাসীদের তাদের সে চাহিদা পূরণ করতে হয় বলে গ্রামবাসীরা জানান। তাদের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে অত্যাচার চালানো হত।

আরও জানা গেছে, বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের অত্যাচার ও শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৬ সালের দিকে প্রায় ২০-৩০টি ম্রো পরিবার গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে পাড়ি জমান। এভাবেই ৭ বছর যাবত বলাই পাড়া সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের কর্তৃক আদিবাসী ম্রোদের উপর অত্যাচার ও শোষণ চলছে। সেনা সদস্য কর্তৃক নির্যাতনের ভয়ে যা এতদিন কাউকে প্রকাশ করেনি দুই এলাকার গ্রামবাসীরা।

বলাই পাড়ার এক ম্রো বৃদ্ধার সাথে আলাপকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, আলীকদমের যে কয়েকটা গ্রামে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা গেছে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনী দায়ী। তারা ঠিকমত চিকিৎসা দিলে ১ জন মানুষও মারা যেত না। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা দেয়ার নাম করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের সেনা ক্যাম্পের আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ করানো হত। গাছ-বাঁশ কাটানো হত। ঔষুধ দেরিতে দেয়া হত। এককথায় চিকিৎসার নাম করে স্থানীয় ম্রোদের হয়রানি করা হত।