হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ ১২ জুন ২০২৫, সকাল ১০ ঘটিকায় ‘নারী নিপীড়নের বিচারহীনতা বন্ধ কর, কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার কর’ এ দাবিতে রাষ্ট্রীয় মদদে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার ২৯ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম গমহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন, রাঙ্গামাটির জেলা কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সভাপতি রিতা চাকমার সভাপতিত্বে ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। বিশেষ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কল্পনা অপহরণ মামলার আইনজীবী এডভোকেট জুয়েল দেওয়ান ও এডভোকেট কক্সি তালুকদার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহসভাপতি কবিতা চাকমা।
প্রধান আলোচক ঊষাতন তালুকদার বলেন, পুরুষ শাসিত সমাজের বাধা অতিক্রম করে কল্পনা হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠ। রাষ্ট্র এই কন্ঠকে ভয় পায়। কল্পনা চাকমার এ অপহরণের ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্ব জানে। তারপরও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার করা যায়নি। এদেশে আইনের শাসন নেই। তাইতো রাষ্ট্র পরিকল্পনামাফিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কল্পনা চাকমার অপহরণের মামলাকে থামিয়ে দিচ্ছে। কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও একটিও আলোর মুখ দেখতে পায়নি। এদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বরাবরই রয়ে গেছে। এ দেশের সরকার মেহনতি মানুষের জন্য নয়। তাইতো কল্পনা চাকমার অপহরণের ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। কল্পনা চাকমা অপহরণের মামলার ন্যায়বিচারের জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে সঞ্চয়, সুহাসদের মত নীতিভ্রষ্ট ব্যক্তিদের বানানো রঞ্জিত কাহিনীতে বিভ্রান্ত না হয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সত্যকে বেছে নিন। একসঙ্গে দুটি সত্য হতে পারে না। জনগণকে সত্যকে বেছে নিয়ে, সেই সত্যকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। আর আমাদের চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রামে জুম্ম জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে।
বিশেষ আলোচক এডভোকেট জুয়েল দেওয়ান বলেন, ২৯ বছর আগে ঠিক এই সময়ে আমরা হারিয়েছি কল্পনাকে, সে সময়ে তার বড় ভাই বাঘাইছড়ি থানায় যখন মামলা করতে যান তখন সে মামলাটি নিতে চাইনি তখনকার অফিসার। এটি কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যারা আইন নিয়ে কাজ করে তারা প্রত্যেকে জেনে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ২৯ বছরে নানা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে অপহরণ বিষয়টি নিয়ে। মনতোষ, সমর বিজয়দের যে আত্মত্যাগ সেটা এই অপহরণকে ঘিরেই। তখন রাষ্ট পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কল্পনা চাকমা ভারতে আছেন। এটি ঘোলা পানিতে মাছ ধরার মতো মন্তব্য। রাষ্ট্র জানে, কল্পনা হারিয়ে যাওয়ার পেছনে কারা দায়ী। সেজন্য ঘটনাটি ঢামাচাপা দিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এখনো। তিনি বলেন, কল্পনা চাকমার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা থেমে থাকবো না।
বিশেষ আলোচক এডভোকেট কক্সি তালুকদার বলেন, আজ ২৯ বছরে এসে কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনার যথাযথ বিচার না হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারিক প্রক্রিয়ায় একটি হতাশার দিক ফুটে উঠে। অপহরণ মামলাটি ২৮ বছরে এসে আদালত মামলাটি খারিজ করে। তবে আমরা চুপ থাকবো না, এই অন্যায়ের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে যাবো।
উক্ত আলোচনা সভা ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।
উক্ত বিবৃতিতে মামলার সর্বশেষ অবস্থা বিষয়ে বলা হয়, ‘গত বছরের ২৩ এপ্রিল ২০২৪ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার নারাজী আবেদন খারিজ করে ২০১৮ সালে তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার দ্বিতীয় দফায় তদন্ত শেষে আদালতে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন সেটিই বহাল রাখে। বাদীপক্ষ ২০২৪ সালের ৮ জুলাই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি পুনর্বিবেচনা বা রিভিশনের জন্য রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করে। আদালত আবেদনটি গ্রহণ করে গত বছরের ১৭ নভেম্বর শুনানির তারিখ ধার্য্য করলেও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি যা সময় ক্ষেপণ করে বিচারিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার মনোভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।’
এতে উল্লেখ করা হয়, ‘২০২৪ সালে মুসলিম সেটেলার কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ১২টি সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৬ জন জুম্ম নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশের দুর্বল অভিযোগ গঠন ও ভূমিকার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তারের কয়েক দিন পরে জামিনে জেল থেকে বের হয়ে যায়। ফলে এ যাবৎ জুম্ম নারী ও শিশুর উপর সংঘটিত কোনো ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে জুম্ম নারী ও কন্যাশিশুর উপর অব্যাহতভাবে লোমহর্ষক সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়ে আসছে।’
বিবৃতিতে নিম্নোক্ত দাবিও জানানো হয়-
১. অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করা এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা।
২ অভিযুক্ত কল্পনা অপহরণকারীদের এবং রূপন, সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমার হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩ জুম্ম নারী সমাজের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকল্পে এবং পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা।
+ There are no comments
Add yours