রাষ্ট্র কল্পনা চাকমার হদিস দিতে পারেনি, এটা দেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য চরম লজ্জার: সমাবেশে বিজয় কেতন চাকমা

0
74

হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২৪, রাঙ্গামাটি: আজ ১২ জুন ২০২৪, বুধবার, নিম্ন আদালতে কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে এবং অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার মো: নুরুল হক ও মো: সালেহ আহমদের বিচারের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং অপহরণ ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও যথাযথ বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ম্রানুচিং মারমার সঞ্চালনায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক আশিকা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি জিকো চাকমা, কল্পনা চাকমার মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান, আইনজীবী সুস্মিতা চাকমা ও এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি শ্রী বিজয় কেতন চাকমা।

সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রী সদস্য এনু মারমা। লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সমাবেশের কেন্দ্রীয় সদস্য ভদ্রা দেবী তঞ্চঙ্গ্যা। সমাবেশের আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প ঘুরে এসে ডিসি অফিসের সামনে থামে।

সমাবেশে বিজয় কেতন চাকমা বলেন, কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা ২৮ বছর হলো। রাষ্ট্র তার কোনো হদিস দিতে পারেনি। আবার কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলাটিও নিম্ন আদালতে খারিজ করে দেয়া হলো। স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এটা দেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য চরম লজ্জার। তদন্ত কমিশন স্বীকার করেছিল, কল্পনা চাকমা অপহরণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তবুও এই রাষ্ট্র সুষ্ঠু বিচার প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

তিনি সমবেত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে বলেন, রাষ্ট্রের শত অপমান, বঞ্চনা, শোষণ, অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার দিন একদিন উপস্থিত হবে। সেদিন ন্যায়বিচার, অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে।

কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার বাদী পক্ষের আাইনজীবী জুয়েল দেওয়ান বলেন, আজকের দিনটি অত্যন্ত দুঃখের। কল্পনাকে হারিয়ে আমরা একজন সাহসী সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। চুক্তির পর আমরা আশা করেছিলাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে। কল্পনা চাকমার অপহরণের বিচার হবে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র সমস্যাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা জারি রেখেছে। কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি নিম্ন আদালতে খারিজ করে দেয়া হলো। কিন্তু আমরা দমে যাবো না। ন্যায় বিচারের জন্য যেখানে যা দরকার আমরা সেটা করবো। এই আন্দোলন, লড়াই সংগ্রাম সর্বস্তরে চলমান থাকবে।

আইনজীবী সুস্মিতা চাকমা বলেন, ২৮ বছর আগে বাঘাইছড়ির লাল্যাঘোনার কল্পনা চাকমা একজন সম্ভাবনাময়ী তরুণী, প্রতিবাদী নারী, যে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন এবং তার বিচার চাইতে গিয়ে আরও অনেক প্রাণ ঝরেছে, অনেক অনেক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু ২৮ বছর পরে আমরা শুনতে পাচ্ছি, কল্পনা চাকমাকে কেউ অপহরণ করেনি। কল্পনা চাকমার অপহরণে কেউ দোষী নয়। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!

তিনি আরও বলেন, একজন কল্পনা চাকমা, তার মা, তার ভাইয়ের যে আকুতি, শতশত জনগণের যে চাওয়া তা আজকে পূরণ হচ্ছে না। ২৮ বছর পর এসে আমরা শুনতে পাচ্ছি, কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু সেখানে কে জড়িত, কারা করেছে সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অর্থাৎ রাষ্ট্র সেখানে অপরাধীদের খোঁজ পাচ্ছে না। রাষ্ট্রের চোখে ঠুলি পড়ে আছে, রাষ্ট্র দেখে না, রাষ্ট্র অন্ধ হয়ে গেছে। এটা কি স্বাধীন বাংলাদেশ? এটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি।

তিনি আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা এবং পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে এই সমস্ত ঘটনাগুলো আরও বেড়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানান।

সমাবেশ শেষে ১০ সদস্যসের একটি প্রতিনিধি দল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে নিম্নোক্ত দাবিনামা জানানো হয়-

১. অবিলম্বে কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করা এবং যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা।
২. অভিযুক্ত কল্পনা অপহরণকারীদের এবং রূপন, সুকেশ, মনোতোষ ও সমর বিজয় চাকমার হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. জুম্ম নারী সমাজের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকল্পে এবং পার্বত্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা।

উক্ত কর্মসূচি ছাড়াও মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত একটি প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়:

“সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক আলোড়ন তুলে। ঘটনার পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠে। ফলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন। সাবেক বিচারপতি আব্দুল জলিল একজন সৎ বিচারপতি ছিলেন। এ জন্য তিনি কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রকৃত সত্যতা খুজঁতে ১৯৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন চাপে সত্যটা প্রকাশ করতে পারেননি। তবে জলিল কমিশনের একটা বক্তব্য ছিল, স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন, তবে কার দ্বারা অপহৃত হয়েছেন সেটি তিনি বলে যাননি। ১২ জুন ১৯৯৬ ভোর হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কল্পনার খোঁজখবর নিয়েও কোনো হদিশ না পাওয়ায় কল্পনার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা স্থানীয় মুরুব্বি সম্রাটসুর চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমাকে নিয়ে বাঘাইছড়ির টিএনও (বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট বিষয়টি অবহিত করেন। বাঘাইছড়ি টিএনওর কাছে বর্ণিত বিবরণের অংশবিশেষ থেকে নিয়ে বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে একটি অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং থানায় তা মামলা নং ২, তারিখ ১২/০৬/৯৬ ধারা ৩৬৪ দ: বি: হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

নথিভুক্ত হওয়ার প্রায় ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশের চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হলেও সেই রিপোর্টে অভিযুক্ত ও প্রকৃত দোষীদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে উক্ত চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।”

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, “অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক যে, গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতও মামলার ৩৯তম কর্মকর্তার চূড়ান্ত রিপোর্টটি গ্রহণ করে এবং বাদী কালিন্দী কুমার চাকমার নারাজী আবেদন নাকচ করে মামলাটি চূড়ান্তভাবে অবসানের রায় দেন। কল্পনার হদিশ, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং ভুক্তভোগী পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করেই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের যেমন অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে, তেমনি অপরদিকে ভুক্তভোগী কল্পনা ও তার পরিবারের মানবাধিকারকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং বিচারহীনতার চরম এক নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।”