হিল ভয়েস ৯ আগস্ট ২০২৫, রাঙ্গমাটি: Indigenous people and AI : Defending rights shaping futures “আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যত গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ প্রতিবাদ্যকে সামনে রেখে রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণে আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস-২০২৫ উপলক্ষে আজ ৯ আগস্ট ২০২৫ এক সমাবেশ ও র্যালি আয়োজন করা হয়।
উক্ত সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ২৯৯নং পার্বত্য রাঙ্গামাটি সংসদীয় আসনের সাবেক সাংসদ শ্রী ঊষাতন তালুকদার এবং উদ্বোধক হিসেবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কবি শ্রী শিশির চাকমা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য শ্রীমতি নিরুপা দেওয়ান। সমাবেশে আরও সংহতি বক্তব্য রাখেন থুয়াইসাপ্রু খিয়াং, আশীষ আসাম, ক্যাচিংনু মারমা, বিশ্বজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, নিকোলাই পাংখোয়া প্রমুখ।
সমাবেশের শুরুতে বেলুন উড়িয়ে উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের উদ্বোধক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কবি শ্রী শিশির চাকমা এবং এরপররই মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শুরু হয়।
ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘আজ বাংলাদেশ ছাড়াও সারাবিশ্বে ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হচ্ছে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ৭০টি দেশে বসবাসকারী ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর উপর বৈষম্য ও আগ্রাসন জাতিসংঘ স্বীকার করেছে এবং এই দিবসটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে; একইসাথে প্রতিবছর পালন করে থাকে। জাতিসংঘ এই দিবসটি পালন করে এই কারণে যে, আদিবাসীদের যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও প্রথাগুলো রয়েছে, সেগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, আমাদের ভাষা যাতে হারিয়ে না যায়। কিন্তু অতীব দুঃখের ও লজ্জ্বাস্কর যে, বাংলাদেশের কোন সরকার এই আদিবাসী অধিকার স্বীকৃতি দেয় নি। এই দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনও করেনা বরং জোর করে নাম চাপিয়ে দিয়েছে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইত্যাদি অভিধা। এই বাংলাদেশ আমাদেরকে স্বীকৃতি দিতে চায় না কারণ আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে আত্ময়িন্ত্রণাধিকার দিতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক উপস্থিতি ও নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে, জোর করে ভূমি দখল করা যাবে না। অধিকন্তু আমরা দেখেছি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আদিবাসী শব্দটি বলায় কিছু মানুষ চেচিয়ে উঠেছে, তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে, যেন মনে হয় তিনি মহা অপরাধ করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজকের সমাবেশে আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ঐক্যবদ্ধতা এটিই প্রমাণ করে আমরা আদিবাসী অধিকার চাই, আমরা আগামী সংবিধানে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামকে শত্রু ভেবে আচরণ করলে সেটার পরিণতি কি হবে, সেটি আপনারাই ভালোভাবে জানেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা কতটুকু শক্তিশালী তা নির্ভর করছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের উপর। আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকট ও বৈষম্যের পরিবেশকে রুখে দিতে সচেতন হয়ে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মধ্যেও চুক্তির পরবর্তী থেকে নানা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আর্বিভাব লক্ষ্য করেছি এবং তারা চুক্তির বাস্তবায়নের পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এই গোষ্ঠীদেরকেও প্রতিহত করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আপামর জুম্ম জনগণকে আহ্বান জানান।’
শিশির চাকমা বলেন, ‘বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ রয়েছে। তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সামাজিক রীতিনীতি,স্বাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানায়। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের কথাগুলো কোনবার গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অব্দি বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন কিন্তু দুঃখের বিষয় এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বারবার। ২০২৪ এ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণদের যে জোয়ার এসেছে, বলা হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিবর্তে বহুত্ববাদের কথা। কিন্তু এদেশের মানুষ বহুত্ববাদকে ধারণ করতে পারবে কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ২৮ বছর পরও মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ দেখা যায় নি । আর চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতায়ন না করে বরং আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর অবস্থায় রাখা হয়েছে। শেষে তরুণ সমাজকে হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যক দেশে বিনা সংগ্রামে স্বাধীনতার স্বাদ কেউ পাইনি। তাই রাষ্ট্রের জাতিগত বিভাজন করার ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করতে হবে।’
শ্রীমতি নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যত গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা বলা হয়েছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ নেই,নেটওয়ার্ক নেই, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, ভালো চিকিৎসা নেই, আর এই পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীদের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা প্রযুক্তি ব্যবহার ঠিক মতো পৌছাতে পারেনি। বর্তমান সময়ে তথ্য প্রযুক্তির যুগেও পার্বত্য চট্টগ্রামে মানুষ পিছিয়ে থাকার দায়ভার বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার একদিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে আদিবাসী স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতি দিলেও অন্যদিকে দেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেই চলেছে। এই বিষয়টি শুধু আদিবাসীদেরকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করছেনা বরং আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনগুলোকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের অধিকার নিয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, সেই সাথে তরুণদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী বিজ্ঞান্তর তালুকদার, নীতি ভূবন চাকমা ও সানুচিং মারমার যৌথ সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ক অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার এবং সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ক অঞ্চলের সভাপতি শ্রী প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব: উপ সচিব)।
সমাবেশের শেষে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি রাঙ্গামাটি পৌরসভা প্রাঙ্গণ থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে এসে অনুষ্ঠানটি আনুষ্ঠিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
+ There are no comments
Add yours