রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে পিসিপি ও এইচডাব্লিউএফ এর যৌথ উদ্যোগে নবীন বরণ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ২০২৫ অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ২৪ জুলাই ২০২৫ রাঙ্গামাটি : আজ (২৪ জুলাই) “আলোর দিশারী নবীন দল, শেকড়ের টানে এগিয়ে চল”এই স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন (এইচডাব্লিউএফ), রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার যৌথ উদ্যোগে “নবীন বরণ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ২০২৫” আয়োজন করা হয়।

উক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি ১ম বর্ষ ও ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বরণ ও কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আজ সকাল ১০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।

উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনসংহতি সমিতির সহ সাধারণ সম্পাদক উ উইন মং জলি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট চঞ্চু চাকমা, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক ও ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব অনির্বাণ বড়ুয়া, পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক অন্তর চাকমা, পিসিপির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি সুমন চাকমা ও এইচডব্লিউএফের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ম্রানুসিং মারমা।

অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন এইচএসসি ২য় বর্ষের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী বৈশালী চাকমা। নবীনদের পক্ষ থেকে বক্তব্য প্রদান করেন এইচএসসি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী লিসা চাকমা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উ উইন মং জলি নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ছাত্র-যুব সমাজ হচ্ছে ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের কান্ডারী। শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে কয়েকটি সার্টিফিকেট অর্জন করে চাকরি নামক শৃঙ্খলার দাসত্বকে মেনে নেয়। কারণ দেশের সকল পাঠ্য-পুস্তক নির্দিষ্ট একটি শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছানুযায়ী লিপিবদ্ধ হয়। তারা চায় কেউ যেন তাদের ভুলগুলোকে ধরিয়ে দিতে না পারে, তাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলতে না পারে। তাই শাসকগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি গন্ডিবদ্ধ, আত্মমুখী,স্বার্থপরতাপূর্ণ এবং শাসন-শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনবিমূখ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, যাতে তারা শাসন করতে পারে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষায় পাশ করার, বেশি নাম্বার পাওয়ার ও চাকরি পাওয়ার মানসিকতা পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের এসব মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। শিক্ষার্থীদের পাশ করার পাশাপাশি মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হবে। শুধু মেধাবী হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না। একজন ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে সুশিক্ষার মাধ্যমে সৎচরিত্র, নীতি-আদর্শসহ মানবিক গুণাবলীগুলো অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করার কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী না হয়ে শিক্ষার্থী হওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি আরো বলেন, একজন মানুষ যত উচ্চ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হন না কেন তার নিজের শেকড়কে ভুলে যেতে নেই। নিজের জাতির ইতিহাস অধ্যায়ন করে নিজের সংস্কৃতি,ঐতিহ্য, ইতিহাস, কৃষ্টি তধা জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে।

চঞ্চু চাকমা বলেন, শিক্ষা মানুষের ভেতরের মনুষত্ববোধকে জাগ্রত করতে পারে। শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডিবদ্ধ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবমুখী ও মানবিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হতে হবে। ছাত্র সমাজ হল স্বাধীন সমাজ। তাই শিক্ষার্থদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কৃত করে লড়াকু চেতনাকে জাগিয়ে তুলে সমাজকে পরিবর্তন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

অনির্বাণ বড়ুয়া বলেন, শিক্ষার মাধ্যমে একজন মানুষ আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। ছাত্র জীবন হল জীবন গঠনের একটি প্রস্তুতি। এই ছাত্র জীবনেই একজন মানুষ যথাযথ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে জ্ঞানের সঠিক চর্চা করতে পারে। যার ফলে একজন মানুষের মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। শিক্ষকরা হল শিক্ষার্থীদের পিতৃ সমতুল্য। শিক্ষকরা সঠিক পথ দেখিয়ে দিবে আর শিক্ষার্থীদের সে পথে এগিয়ে যেতে হবে। তাই শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে নিজেকে সর্বক্ষেত্রে বিকশিত করে সঠিক পথে চলতে হবে।

অন্তর চাকমা বলেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য সাধনা করতে হয় আর শিক্ষা লাভের মধ্যে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব অর্জন হয়। একজন মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে জন্ম লাভ করে কিন্তু জ্ঞান, শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত আমাদের জুম্মা শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইতিহাস জানার প্রয়োজন বোধ করে বলে মনে হয় না। সময় গড়িয়ে চলেছে। তাই শিক্ষার্থীদের শেকড়ের টানে নিজের জাতি, সমাজের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে ভাববার, জানবার সময় এখনই। নিজেকে সব ক্ষেত্রে বিকশিত করে নিজের জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁদে নেওয়া সময় এসে গেছে।

তিনি শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের এলাকার সমস্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা তথা সমগ্র জুম্ম জাতির সমস্যা উপলব্ধি করে লড়াই সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে জুম্ম জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহবান জানান।

সুমন চাকমা বলেন, শিক্ষা হল মানবজাতির উন্নতির এক অনন্য হাতিয়ার। শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে সুশিক্ষিত করে দেশ, জাত ও সমাজের উন্নতি এবং পরিবর্তন সাধন করা যায়। আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থী এখন সমাজের নেতিবাচক দিকগুলোর দিকে ধাবিত হচ্ছে। যার ফলে দেশে ধর্ষণ, খুন, নারীদের নিপীড়ন, নারী নির্যাতনসহ নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপগুলো ঘটে চলেছে। ছাত্র সমাজকে এসব নেতিবাচক দিকগুলো থেকে বেড়িয়ে এসে নিজের বিবেককে জাগিয়ে তুলে প্রকৃত মানুষ হিসেবে ধরে রাখতে হবে। সমাজের নেতিবাচক এ দিকগুলোকে পরিবর্তন করার জন্য ছাত্র সমাজকে এর দায়িত্ব নিতে হবে।

ম্রানুসিং মারমা বলেন, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম শিক্ষার্থীদের নানা বাস্তবতা ও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের এসব বিষয় উপলব্ধি করে নিজেকে সবসময় সৎপথে পরিচালিত করতে হবে। বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা বাদ দিয়ে মোবাইল ফোনের প্রতি অনেক বেশি সময় ব্যয় করে। তাদের মোবাইল ফোনের সদ্ব্যবহার করতে হবে। আর তিনি শিক্ষার্থীদের পাহাড়ের নানা বাস্তবতা উপলব্ধি করে পড়াশোনার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস অধ্যয়ন করে নিজের মাতৃভূমি রক্ষায় নিয়োজিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার পিসিপির সাধারণ সম্পাদক জ্ঞান চাকমা ও এইচডব্লিউএফের সভাপতি এলি চাকমার যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সজল চাকমা। আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিত চাকমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে উত্তরীয় পরিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেয়া হয়।

শেষে সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির ১ম পর্বের নবীন বরণ, কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় পর্বে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত আদিবাসী  শিক্ষার্থীরা।

More From Author