হিল ভয়েস, ২৮ নভেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রবিধান অনুসারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের দাবি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের ২২টি সংগঠন। আজ শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানের স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই দাবি জানায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া নাগরিক সমাজের উক্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, গত ২০শে নভেম্বর ২০২৫ তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা চতুর্থ বারের মত স্থগিত করা হয়েছে। এতে অংশ নেওয়া পরিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। সেই সাথে দেখা দিয়েছে তাদের নিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সার্বিকভাবে পার্বত্য রাঙ্গামাটির ১০ উপজেলার সকল প্রাথমিক বিদ্যালগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু একটি জেলায় পাঁচশত অধিক সহকারী শিক্ষক পদ আজ থেকে এক যুগ যাবৎ শূন্য অবস্থায় থাকায় অত্র জেলার শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছেছে। তাই অতি শিঘ্রই এই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়া জরুরী।
গত ২৭/০৮/২০২৫ তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ইহার কর্মচারী প্রবিধানমালার সংশ্লিষ্ট প্রবিধান মোতাবেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য পরিষদ তৃতীয় বারের মত পূনঃবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ১৪ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখে উক্ত সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি বিশেষ মহলের বিরোধীতার কারণে ১১/১১/২০২৫ খ্রি: তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয় সহকারী শিক্ষক পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া স্থগিত করার ঘোষণা প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১২/১১/২০২৫ খ্রি: তারিখে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রার্থীদের পক্ষ হতে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করার জন্য একটি স্মারকলিপি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়ের বরাবরে পেশ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৩/১১/২০২৫ তারিখে চতুর্থ বারের মত ১৪ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ তারিখের উক্ত সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা করা হয়।
১৭ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিঃ তারিখে কোটাবিরোধী ঐক্যজোট ও রাঙ্গামাটি সচেতন নাগরিক ঐক্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক পদে ৭% কোটা ভিত্তিতে ও ৯৩% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করার দাবী সহ মোট ৬ (ছয়) টি দাবী সম্বলিত স্মারকলিপি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এর বরাবরে পেশ করে। এর পরবর্তীতে ১৯ নভেম্বর ২০২৫ খ্রি: তারিখে তারা সাংবাদিক সম্মেলন করে ২০ ও ২১ নভেম্বর (০২ দিন ব্যাপী) হরতাল আহ্বান করে।
২০ নভেম্বর ২০২৫ খ্রি: তারিখে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মহোদয় সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি পরিহারের উদ্দেশ্যে ২১ নভেম্বর ২০২৫ খ্রি: তারিখে নির্ধারিত নিয়োগ পরীক্ষা পুনরায় স্থগিত ঘোষণা করেন। তারই প্রেক্ষিতে ২২/১১/২০২৫ খ্রি: তারিখে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ প্রার্থীদের পক্ষ হতে পরীক্ষার স্থগিতাদেশ বাতিল করার এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন অনুসারে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ২ (দুই) দফা সম্বলিত দাবীনামা পেশ করা হয়। একই দিন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয় আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষসমূহের ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাথে মতবিনিময় সভা করে সাংবাদিক সম্মেলন ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন। বলা হয় যে, সরকার হতে পরামর্শ পাওয়া সাপেক্ষে শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এটা বলা আবশ্যক যে, দীর্ঘ দুই যুগ আলোচনার পর, ০২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রি: তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানকল্পে বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারই আলোকে রাঙ্গামাটি/খাগড়াছড়ি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৮৯ সনের ১৯/২০/২১ নং আইন), পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ১২ নং আইন) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত এ্যালোকেশন অব বিজনেস-এ সন্নিবেশিত হয়। চুক্তির মাধ্যমে ও উল্লেখিত প্রত্যেক আইনে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে প্রণীত রাঙ্গামাটি/খাগড়াছড়ি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইন, ১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ৯/১০/১১ নং আইন) দ্বারা ১৯৮৯ সনের ১৯/২০/২১ নং আইন সংশোধন করা হয়। উক্ত সংশোধিত আইনসমূহের ধারা ২৫ বলে ১৯/২০/২১ নং আইনের ধারা ৫১ ও ৫২ বিলুপ্ত করা হয়, অর্থাৎ সরকার কর্তৃক উক্ত পরিষদসমূহের উপর সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা অপসারণ করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ্যালোকেশন অব বিজনেস এর এন্ট্রি ৩-এ বর্ণিত হয় যে, এ মন্ত্রণালয় অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে সমন্বয় সাধন করবে এবং এন্ট্রি ৭-এ বর্ণিত হয় যে, এ মন্ত্রণালয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের সমুদয় কার্যাবলী সম্পাদন (deal) করবে।
আরো উল্লেখ্য যে, ২০ নভেম্বর ২০২৫ খ্রি: তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রচারিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি হতে জানা যায় যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীকালে সরকার ঘোষিত কোটা পদ্ধতি পার্বত্য জেলাগুলোতে প্রযোজ্য হবে কিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পত্র প্রেরণ করলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর মতামত গ্রহণ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। এ প্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিষয়টি সম্পর্কে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করেছে। বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থার প্রেক্ষিতেই ২৩ জুলাই ২০২৪ খ্রিঃ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংশোধিত আকারে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে। উক্ত সাধারণ কোটা ব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাকরিতে কোনকালেই প্রয়োজ্য হয়নি এবং প্রযোজ্য হতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের অনুচ্ছেদ ১৮তে বর্ণিত হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি, আধা-সরকারি, পরিষদীয় ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে সকল স্তরের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারী পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী অধিবাসীদের নিয়োগ করা হবে। চুক্তির উক্ত বিধান মোতাবেক ২৭ জুন ২০২৩ খ্রি: তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে উক্ত একই ধরনের বিধান বর্ণিত হয়। রাঙ্গামাটি/ খাগড়াছড়ি/বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৮৯ সনের ১৯/২০/২১ নং আইন) এর ধারা ৩২ এর উপ-ধারা (২)-এ বর্ণিত হয় যে, “পরিষদ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলার উপজাতীয় বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার বজায় থাকবে।”
সঙ্গতকারণে, এ যাবত উল্লিখিত চুক্তির বিধান, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনসমূহে বর্ণিত বিধান এবং চুক্তি বিধান মোতাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত প্রজ্ঞাপন অনুসরণে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করে আসছে।
পরিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র নাগরিক সমাজ এই দাবী রাখা হয় যে, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ পূর্বের ন্যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও অন্যন্য পদের চাকরিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ যাবতকালে যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান (‘ঘ’ খন্ডের অনুচ্ছেদ ১৮) ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের বিধান (ধারা ৩২ এর উপ-ধারা ২) ও ২৭ জুন ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের অনুচ্ছেদ ১৮ মোতাবেক জারীকৃত বিধান অনুসরণ করে আসছে সে একই বিধান অনুসরণ করে সংশ্লিষ্ট সকল নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।
সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র নাগরিক সমাজ প্রত্যাশা করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ সরকারের সকল কর্তৃপক্ষ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাঁর নিজস্ব আইন অনুসরণে যথাণীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরামর্শ প্রদান করবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের পক্ষে বিবৃতি প্রদানকারী ২২টি সংগঠন হলো- ১. পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি; ২. পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সম্পদ নেটওয়ার্ক; ৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্ক; 8. রাঙ্গামাটি জেলা হেডমোন এসোসিয়েশন; ৫. কাপ্তাই বাঁধ উদ্বাস্তু কল্যাণ সমিতি; ৬. জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জেএসি); ৭. রীদিসুদোম জধা রাঙ্গামাটি; ৮. পার্বত্য চট্টগ্রাম রাইটার্স ইউনিয়ন, ৯. বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল; ১০. হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা শাখা; ১১. বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা শাখা; ১২. উন্মেষ; ১৩. অহমিয়া (আসাম) কল্যাণ সংসদ; ১৪. প্রো-বেটার লাইফ (পিবিএলএ বাংলাদেশ); ১৫. হিল লয়ার গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন; ১৬. বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল (BMSC); ১৭. ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম (টিএসএফ); ১৮. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্র কল্যাণ ফোরাম; ১৯. বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএসএ); ২০. বাংলাদেশ খিয়াং ছাত্র ইউনিয়ন (বিকেএসইউ); ২১. বম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএ); এবং ২২. বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।