হিল ভয়েস, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাঙ্গামাটি সদরের কালিন্দীপুর এলাকার নিউ মার্কেটস্থ আশিকা কনভেনশন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এই সময় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন শিশির চাকমা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঊষাতন তালুকদার, কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান, সহসভাপতি, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক; অ্যাডভোকেট জুয়েল দেওয়ান, আইনজীবী; বিজয় কেতন চাকমা, সভাপতি, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন; আশিকা চাকমা, সহ সাধারণ সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিত, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটি; রুমেন চাকমা, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।
সভায় ঊষাতন তালুকদার বলেন, ঘুমন্ত জুম্মজাতির এক আলোকউজ্জ্বল নাম মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের মধ্যে এখনও আত্মমুখীনতা, সুবিধাবাদী মানসিকতা, আপোষমুখী মানুষ রয়েছে। এই মানসিকতা যদি জুম্ম জনগণ পরিহার করতে না পারে, যতক্ষণ সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে না পারবে, ততদিন বিভ্রান্তের মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। তিনি শিক্ষিত ছাত্র যুবসমাজকে নিজেকে জেনে, জাতিকে জেনে এবং পৃথিবীকে জেনে জনসংহতি সমিতির পতাকা তলে এসে নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতির স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানান।
শিশির চাকমা বলেন, শোষণে ভরা একটি জাতিকে সচেতন করে তুলতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলো শিক্ষা। সেটিই প্রথম করেছিলেন এম এন লারমা। কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে ছাত্র-যুবকদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং শিক্ষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতার পেশা।
একদিকে জুম্ম জনগণের অশ্রুতে নির্মিত পাকিস্তান আমলের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ, অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতিগত বৈষম্য। সবকিছুই কেবল এই জুম্ম জনগণকে কাঁদিয়েছিলো। তবে এম এন লারমা পার্বত্য অঞ্চল পেরিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের দুঃখ বঞ্চিত মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সামন্তীয় ঘুণে ধরা ভিন্ন ভাষাভাষী চৌদ্দটি জাতিগোষ্ঠীকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্লামেন্টে লড়েছিলেন মানবেন্দ্র লারমা।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলে এম এন লারমা নিয়মতান্ত্রিকতার পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিকতার পথ বেঁচে নেন। অধিকারের লড়াইয়ের সংগ্রাম চলছিল দুর্বার গতিতে। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে যখন অন্তঃকোন্দল শুরু হয়, তখনো তিনি কুচক্রী ও বিভেদপন্থীদের বিশ্বাস করেছিলেন। সে কারণে তিনি দলের মধ্যে ‘ক্ষমা করো ও ভুলে যাও’ নীতি প্রচার করেছিলেন। তবে মানুষের প্রতি তাঁর সেই বিশ্বাস পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে নিয়ে এসেছে কলঙ্কময় অধ্যায়। তাঁরই কিছু বিপথগামী সহকর্মী এই মহান নেতার মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর দেখানো পথটি অনুসরণ করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে যাচ্ছেন তরুণেরা।
আমাদের মুক্তির দিক নির্দেশনা হবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চেতনাকে ধারণ করা। লড়াই সংগ্রাম ছাড়া পৃথিবীতে কোনো জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকেনি। তাই তিনি অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তরুণদেরকেই অধিকতর সামিল হওয়ার আহবান জানান ।
আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান বলেন, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জুম্ম তথা মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছিলেন। তৎকালীন সরকার এবং বর্তমান সরকারসহ আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু লারমা সর্বোচ্চ অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি ছাত্র সমাজকে লারমার আদর্শকে অধ্যয়ন করার আহ্বান জানান।
এডভোকেট ভবতোষ দেওয়ান বলেন, এম এন লারমার দেখানো দর্শন ছাত্র সমাজকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। লারমার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চূড়ান্ত বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বিজয় কেতন চাকমা বলেন, মৃত্যুকে যতক্ষণ পর্যন্ত জয় করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অধিকার অর্জন করা সম্ভব নয়।অতীতে যারা অধিকারের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন তারা আজ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাদের এই অধিকারের জন্য লড়াইকে অনুপ্রেরণা হিসেবে ধারণ করে তরুণদের বৃহত্তর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান তিনি।
আশিকা চাকমা বলেন, যদি এম এন লারমার জন্ম না হতো, তাহলে আমরা বিলুপ্তির পথে যেতাম। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার জন্য ছাত্র সমাজকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার আহ্বান জানান।
রুমেন চাকমা বলেন, কাপ্তাই বাঁধের ফলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার চেতনা জাগ্রত হয়। অতীতের সরকার এবং এই বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মান্তরিতকরণ, সামরিকায়ন, ভূমিবেদখল জারি রেখেছে। এই সরকারের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নের অনীহা দেখা যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুনির্মল দেওয়ানের সঞ্চালনায় উক্ত অনুস্থানে সভাপতিত্ব করেন একই কমিটির সভাপতি ডা. গঙ্গা মানিক চাকমা।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন অরুন ত্রিপুরা, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি,রাঙামাটি জেলা কমিটি ।
+ There are no comments
Add yours