মহান নেতা এম এন লারমার ৪২তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রামে আলোচনা সভা ও স্মরণ সঙ্গীতানুষ্ঠান

হিল ভয়েস, ১১ নভেম্বর ২০২৫, চট্টগ্রাম: গতকাল ১০ নভেম্বর ২০২৫ রোজ সোমবার, চট্টগ্রামে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৪২তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও স্মরণ সঙ্গীত অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। চট্টগ্রামস্থ প্রেসক্লাব ভবনের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত স্মরণ সভাটি আয়োজন করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪২তম প্রয়াণ দিবস উদযাপন কমিটি-চট্টগ্রাম।

স্মরণ সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম এর সভাপতি অশোক সাহা, ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম এর সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অজিত দাশ, সিনিয়র সাংবাদিক, আলিউর রহমান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সদস্য জুনিয়া ত্রিপুরা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আদর্শ চাকমার সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা’র ৪২তম প্রয়াণ দিবস উদযাপন কমিটি-চট্টগ্রাম এর আহ্বায়ক তাপস হোঁড় মহোদয়।

এছাড়াও আয়োজিত স্মরণ সভাতে সংহতি বক্তব্য রাখেন পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি হ্লামিউ মারমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দিশান তঞ্চঙ্গ্যা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রিবেক চাকমা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য স্মরণী চাকমা। সভার শুরুতে মহান নেতা এম এন লারমাসহ জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল শহীদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অশোক সাহা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সকল শোষিত জনগণের মুক্তিকামী একজন সংগ্রামী নেতা ছিলেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের সংবিধানে অন্তর্ভূক্তি চেয়েছিলেন। একাত্তর পরবর্তী সময়েও আমাদের দেশে সংখ্যালঘু জনগণের ওপর নির্যাতন হয়েছে, গায়ের জোরে, ক্ষমতার জোরে তাদের ওপর নিপীড়ন হয়েছে। কিন্তু একটা দেশের কোন একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা জাতিকে ফেলে রেখে তো দেশ গঠন করা যায়না। আমরা যদি মনের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ পোষণ করি তাহলে তো একসাথে চলতে পারব না। দেশের জন্য ভালো কিছু করতে হলে সকলকেই সাথে নিয়ে করতে হবে। দেশের আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে সকল মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা দরকার।

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, শাসকের মূল কাজ হল শোষিত গণমানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিভাজন আনা। একটা জাতিগোষ্ঠী যখন শোষিত হয় তখন সকল নিপীড়িত মানুষের সেই শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো উচিত। পাহাড়ী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কোন আঞ্চলিকতাবাদ নেই, বরং এটি শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে  এক আন্দোলন। সরকার পার্বত্য চট্রগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ী মানুষের অধিকারকে স্বীকার করলেও চুক্তি বাস্তবায়ন না করে সেই অধিকার বাস্তবায়ন করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভ্রান্ত পথে এই দেশের শাসকগোষ্ঠী বহুবার হেঁটেছে এখনো হাঁটছে। অন্তর্ভুক্তির নামে অনেক কথা বললেও আদিবাসীদের প্রক্রিয়াগতভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা সমস্ত শোষিত-বঞ্চিত মানুষের নেতা। শান্তিপূর্ণভাবেই তিনি পাহাড়ী জনগণের অধিকার আদায়ের চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা কখনো সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।

অজিত দাশ বলেন, এন এম লারমা পাহাড়ি জুম্ম জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় অনেক কিছু করে গেলেও তিনি কিছু অসমাপ্ত কাজ রেখে গেছে। এ অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি দেশের সকল নাগরিকের সমমর্যাদা ও নায্য অধিকারের জন্য লড়ে গেছেন যা আমাদেরকে সাহস দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোন সরকারই দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে আসেনি। প্রত্যেক সরকার প্রহসনমূলক অনেক উন্নয়ন দেখায় কিন্তু দেশের গণমানুষের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তন হয়না। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমান সময়ে আরও ভয়াবস অবস্থায় পড়েছে। সরকারের উচিত তাদের নায্য অধিকার বাস্তবায়ন করে তাদেরও দেশের অপরাপর নাগরিকের সমমর্যাদা দেওয়া।

আলিউর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। সেই স্বকীয়তাকে ধরে রাখতে গিয়ে রাজনৈতিক জাগরণ ঘটান মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নকালে গণপরিষদে প্রথম এম এন লারমা প্রতিবাদ করেছিলেন। তার প্রতিবাদের লক্ষ্য ছিল পাহাড়িদের জাতীয় অস্তিত্বকে সংবিধানে স্বীকার করা এবং দেশের আপামর জনগনের অধিকারকে সেখানে স্থান দেওয়া। পাহাড়ের প্রধান সমস্যা ভূমি অধিকার কেন্দ্রীক। এই সমস্যা ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কোন শাসকই ঠিকমত সমাধান করে দিতে পারেনি। যার কারণে বার বার ক্ষমতার জোরে বিভিন্ন সময়ে এই ভূমির ওপর দখল কার্যক্রম চলে। আজও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের জমি দখলের অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। সরকারের উচিত পাহাড়ের এই সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানে জন্য এগিয়ে আসা।

এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, আজকে আমরা যার স্মরণে এখানে একত্রিত হয়েছি সেই এম এন লারমা ছিলেন একাধারে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সংগ্রামী নেতা যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীকে সংগ্রামের পথ দেখান। লারমা পাহাড়িদের আন্দোলন শিখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাননি। তিনি আজীবন পাহাড়িদের ভাগ্য পরিবর্তনে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন, তাদেরকে সংগঠিত করেছেন। একজন চাকমা জনগোষ্ঠীর হয়েও তিনি শুধু চাকমাদের নিয়ে ভাবেননি, তিনি সকল নাগরিকের কথা ভেবেছিলেন। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম তথা সারাদেশের নিপীড়িত জনগণের জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

জুনিয়া ত্রিপুরা বলেন, এম এন লারমাকে হত্যার মতো নিকৃষ্ট ঘটনাকে আজকের সচেতন, অধিকারকামী ছাত্রসমাজ ঘৃণাভরে নিন্দা জানাবে। এম এন লারমা আমাদের কাছে মহান তার সংগ্রামী আদর্শ ও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জন্য। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম লারমার সংগ্রামী আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এম এন লারমা কিশোর বয়স থেকে রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন। তার জীবদ্দশায় তিনি যৌবনকালে ঘরে বসে না থেকে পাহাড়ের আনাচে কানাচে বেড়িয়ে পড়েন ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে। আজকের দিনের তরুণরা আন্দোলন-সংগ্রাম বিমুখ। লারমাকে যারা উপলব্ধি করবে তারা স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দিয়ে থাকতে পারেনা। তাই আমাদের উচিত ঐক্যবদ্ধ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে এসে হয়ে জাতির এই সংকটময় সময়কে দূর করা।

এছাড়াও সংহতি বক্তব্য রাখেন, পিসিপি, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি হ্লামিউ মারমা, পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দিশান তঞ্চঙ্গ্যা এবং পিসিপি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তথ্য, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রিবেক চাকমা।

সভাপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘটে। আলোচনা সভা পরবর্তীতে স্মরণ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্মরণ সংগীত পরিবেশন করেন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীবৃন্দ।

More From Author