মহান নেতা এম এন লারমার চিন্তা-চেতনা চিরভাস্বর

0
388

ধীর কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার হারা জুম্ম জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রয়াত মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)’র জীবদ্দশায় “জনগণের জীবনযাত্রার প্রতি যত্নবান হোন” এই উদ্বৃতিকে সামনে রেখে তাঁর জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তাঁর ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবনে। দেখিয়ে গেছেন, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে এই পার্টির (জেএসএস) উদ্দেশ্য-লক্ষ্য পরিপূরণের নীতি-কৌশল। যা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে আছে। দিক নির্দেশনা দিচ্ছে আন্দোলনের আকাবাঁকা পথ চলার।

১৯৭৯ সালের শীতকালে একদা আমরা শত্রুর পরিবেষ্টনী থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে এক সুসংগঠিত অঞ্চলে চলে যাই। সেখানে ছিল ৮০-১০০ পবিারের মতো জুম চাষীর বসবাস। সহজ-সরল এই জুমচাষীদেরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিরাপদ বেষ্টনী। এই জুমচাষীদের কঠোর জীবনযাত্রা আমাদের গেরিলা জীবনকে শাণিত করেছিল তখন। একদিন সেই বেষ্টনীর প্রবেশ পথের গ্রামে সেনাবাহিনী ঝটিকা হামলা চালায়। গ্রামের জনৈক গর্ভবতী মহিলা সেনাদের পদপিষ্ট হয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েও অনতিদূরে গ্রামের পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা শান্তিবাহিনীর সদস্যদের ধরিয়ে দেননি। নীরবে সহ্য করেছিলেন সেনাদের অমানবিক অত্যাচার নির্যাতন। সেদিন সেনারা গ্রামে প্রবেশের কিছুক্ষণ আগে গ্রামের পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা শান্তিবাহিনীদেরকে সেই মহিলা ও তার প্রতিবেশীরা আপন সন্তানের মর্যাদায় আদর আপ্যায়ন করেন। গ্রামে সেনারা প্রবেশের সংবাদ রাষ্ট্র হওয়ার সাথে সাথে গ্রামের পুরুষ লোকরা সবাই যেদিকে পারে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। এমতাবস্থায় সেনারা গ্রামের মহিলাদের উপর তান্ডব চালিয়ে ব্যারাকে ফিরে যায়।

ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের দুই যুগাধিক পরও চুক্তি-পূর্ব কালের নাজুক পরিস্থিতির অনুরূপ ব্যাপক সেনাভিযান অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে। সেই বিভীষিকাময় ঘটনাগুলো আজো আদিবাসী জুম্ম মা-বোনদের মানসপটে ভেসে উঠে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে তাদের গ্রাম আজো জ্বলছে, তাদেরকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

এরকম পরিস্থিতিতে এম এন লারমা আদিবাসী জুম্ম জনগণকে ভালবাসার, নিজের জন্মভূমিকে ভালবাসার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন সেটা বারবার স্মরণ হয়। এম এন লারমার জন্ম নাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে পৃথিবীর মানব সভ্যতা বিকাশের সাথে চির অবহেলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ হতোনা। এম এন লারমার জন্ম নাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম সমাজের ভবিষ্যত, জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজে আন্দোলনের সূর্যোদয় হতো না। এম এন লারমার জন্ম নাহলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় ১৭ আগষ্টে জুম্মদের জন্য সৃষ্ট কালো রাত অবসানের লক্ষে জুম্মদের দুঃখজনক অবস্থার পর্যালোচনা কেহ করতো না। হতো না ষাট দশকের জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজের লড়াকু ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র সমিতির অভ্যুদয়। এম এন লারমার জন্ম নাহলে কাপ্তাই লেকের জলরাশিতে হতভাগ্য জুম্মদের হারিয়ে যাওয়া সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য কোন দাবি-দাওয়ার আন্দোলন হতে পারতো না। সর্বোপরি এম এন লারমার জন্ম নাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আবির্ভাব ঘটতো না। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে থাকতোনা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম তথা সমগ্র দেশের মেহনতি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সাংসদের বলিষ্ঠ এবং জোরালো কোনো কন্ঠস্বর। আজ সেই মহান নেতা এম এন লামার প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা ও নেতৃত্ব উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের নগ্ন হামলায় জর্জরিত। তাই আজকের দিনে এম এন লারমার নির্দেশিত সংগ্রামী জীবনকে আবারো নূতন আলোকে যুগপৎ ধারায় অধ্যয়ন ও অনুশীলন অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের প্রাক্কালে, দু’যুগের অধিক কাল ধরে রক্তপাতময় সংঘাত চলেছিল। পরবতী সময়ে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণেগুণে হারিয়ে গেল পঁচিশটি বছর। সব মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আজকে ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। আজকের দিনেও চুক্তি-পূর্ব কালের মতো নাজুক পরিস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদেরকে চরম উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ আজ হতাশ। হতাশাগ্রস্ত মানুষের দীর্ঘশ্বাস অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্ম দেয়। সেকথা শতভাগ সত্যি। তাই ১৯৭৩ সালে তাঁর জীবদ্দশায় সাংসদ জীবনের পাশাপাশি গেরিলা জীবনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এম এন লারমা। ’৭৩ সালের ৭ জানুয়ারিতে গঠন করেছিলেন শান্তিবাহিনী। এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন হাসিমুখে। জুম্ম সমাজের বাস্তবতার নিরিখে নীতিগতভাবে তিনি ছিলেন আপোষহীন, কিন্তু কৌশলগতভাবে নমনীয়ভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন। আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে নেতার ঘোষিত “ক্ষমা করা ভুলে যাওয়া” নীতিকে উপেক্ষা করে চার কুচক্রী বিভেদপন্থীরা নেতার জীবনাবসান ঘটিয়েছে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার কালো রাতে। ইতিহাসের এই নির্মম বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্ত থেকে জুম্ম জাতিকে বেরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তার জন্য সত্যিকার

দেশপ্রেমিকদেরকে এক পতাকাতলে সমবেত হয়ে জুম্ম জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্মরণ করতে হবে যে, যে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীনে মুক্তিবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আমলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখ লড়াই সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। তারাওতো একদিন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আখ্যায়িত হয়েছিল। অনুরূপভাবে বাংলাদেশ আমলেও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা ‘শান্তিবাহিনী’কে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তৎসত্ত্বেও তৎকালীন সামরিক শাসক লেঃ জেনারেল মুহম্মদ এরশাদ সরকারের প্রস্তাবে, জেএসএস এর সাথে প্রথম সরকারি সংলাপ শুরু হয়েছিল। শুরুতেই স্বীকার করা হয়েছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক সমস্যা। তার পরবর্তীতেও জেএসএস সর্বদাই গণতন্ত্রের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী এবং সচেতন বিধায় ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর সূচিত সংলাপ, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত (আঃলীঃ) সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত চুক্তির মধ্য দিয়ে সমাপ্তি লাভ করে। দু’যুগের অধিক রক্তপাতময় রাজনীতি রূপ নেয় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে। উল্লেখ্য,পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ইতিপূর্বে রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে ইচ্ছুক হলেও সেপথ তৎকালীন সামরিক শাসক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে সামরিক উপায়ে সমাধানের দিকেই ঝুঁকেছিল প্রতিটি সরকারের শাসকগোষ্ঠী।পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর দীর্ঘ ২৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। অপরদিকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনকাল ইতিমধ্যে একাক্রমে ১৪বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মতো একটা চুক্তি বাস্তবায়নে এই ২৪টি বছর কম সময় নয়।

২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু আজো দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের শাসকগোষ্ঠী চুক্তি বাতিল করে সামরিক উপায়ে সমাধানের পথে হাঁটছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। নচেৎ চুক্তি সম্পাদনের ২৫ বছরের মধ্যে একাক্রমে এক যুগেরও অধিক সময় ধরে চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি কেন করতে হয়! আর পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের বৈঠক বাতিলের দাবিতে কেনইবা চুক্তিবিরোধী বহিরাগত সেটেলার বাঙালি সংগঠন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ ইত্যাদি দ্বারা সড়ক অবরোধ ডাকা হয়! যারা দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রেখে সাংবিধানিক অধিকার দাবি করে তারা কোনোদিন বিছিন্নতাবাদী হতে পারে না। অথচ চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াধীনে জেএসএসকে সমর্থন দিচ্ছে সেই শান্তিকামী ও নিরস্ত্র জুম্ম জনগণের কোমরে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করে, স্বাধীন দেশের গৌরব, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেই সেনাবাহিনী তাদের বীরত্ব জাহির করছেন। কঠিন করে তুলেছেন সহজ-সরল জুম্মদের জীবনযাত্রা। এই পরিস্থিতির আশু অবসান নাকরে আগামী দ্বাদ্বশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কতটুকু অবাধ,নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে সেটা সহজে অনুমেয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার পুরনো বোতলে নতুন মদ ঢালার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবাস্তবায়িত রেখে, পুর্বের ন্যায় আবারো “ক্ষমতায় গেলে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে” এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান সরকার কেবলমাত্র নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছে। ইদানিং অভিজ্ঞ মহলের সে প্রশ্নই বিভিন্ন মিডিয়ায় ঘুর-পাক খাচ্ছে।

জনসংহতি সমিতি সেনাবাহিনীর বিরোধী নয়। সাংসদ এম এন লারমাও ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর, সংসদে কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি। বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে বাজেট অধিবেশনে, দেশ রক্ষাখাতে অতিরিক্ত বাজেট প্রণয়ণের জন্য তিনি তার তাৎপর্যপূর্ণ সংসদীয় ভাষণে বক্তব্য রেখেছিলেন। যে সেনাবাহিনী স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত; সেই সেনাবাহিনীকে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করাসহ আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত করার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাম্প্রতিক কালের পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয়, সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি বাতিলের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন হচ্ছে অধিকার হারা জুম্ম জনগণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বোপরি জুম্ম জাতীয় জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে উৎকর্ষ সাধনের লক্ষে বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের আন্দোলন। এটা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আন্দোলন নয়, যেজন্য সেনাবাহিনীকে পার্বত্যাঞ্চলের নিরীহ জুম্ম জনপদে তথাকথিত সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ দমনের নামে রাতদিন টহল দিতে হবে।

জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার থেকে দাবি করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে। যাছিল জুম্ম জনগণের প্রাণের দাবি। ’৭২ থেকে ২০২২ সাল আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলনের ৫০টি বছর পূর্ণ হতে চলেছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিও ২৫ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে আসছে ২ ডিসেম্বর ২০২২ খ্রীষ্টাব্দে। চড়াই-উতরায় পেরিয়ে পেছনে ফেলে আসা এই আন্দোলনে অনেক ঘটনাবহুল অধ্যায়ের মধ্যে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সম্পাদিত, ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হচ্ছে অন্যতম। এই চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণ বাস্তবায়ন নাহওয়ায় জুম্ম জনগণের কাঙ্খিত লক্ষ্য আদৌ পূরণ হয়নি। বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর একটি স্বার্থান্বেষী মহলের মদদপুষ্ট, চুক্তি পরিপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনসমূহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতীয়তাবাদ যাতে প্রতিষ্ঠা লাভ না করতে পারে, তার জন্য ক্ষুদ্র জুম্মজাতিসমূহের মধ্যে ভাগ করা শাসন করা নীতির অধীনে ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী জেএসএস, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), বম পার্টি,মগ পার্টি ইত্যাদি জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল ও ভুইফোঁড় রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে। আর সেই সব সংগঠন মেতে উঠেছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে নিত্য নূতন ষড়যন্ত্র এবং রক্তের হোলি খেলায়। তারই ধারাবাহিকতায় স্বার্থান্বেষী মহলের মদদেজনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মী এবং নেতৃত্বের উপর নানাভাবে আঘাত হানা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে দানা বেঁধে উঠেছে তীব্র গণঅসন্তোষ। এমতাবস্থায় একদিকে ১০ নভেম্বর ২০২২ প্রয়াত নেতা এমএন লারমার ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী, অপরদিকে ২ ডিসেম্বর ২০২২ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি দ্বারপ্রান্তে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার কারণে সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতিতে কোনোরকম অনুষ্ঠান উদযাপনের পরিবেশ নেই। কারণ অনুষ্ঠানে যোগদানকারী জনসাধারণ চরম নিরাপত্তাহীতনায় ভূগছে। পার্বত্য চুক্তি-উত্তর কালেও বিনা প্ররোচনায় তারা সেনাভিযানের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত জীবনহানি থেকে শুরু করে নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছে।

পার্বত্য চুক্তিপূর্ব কালেও দীর্ঘদিন যাবৎ এই রকম দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মেকাবিলার অভিজ্ঞতা জুম্ম জনগণ আজো ভুলেনি। ১৯৭৯ সালে জুম্ম জনগণের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। নানারকম মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে সময়ে অসময়ে ডাক পড়ে হাজিরা দিতে হতো। ক্যাম্প কম্যান্ডার কর্তৃক বাজার অবরোধ ঘোষণা, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারী ইত্যাদি বজায় থাকা সত্ত্বেও পার্টিকে সহযোগিতা করা থেকে জুম্মরা বিরত থাকেনি। এরকম বিরাজমান পরিস্থিতিতে নেতা এম এন লারমা যেভাবে তাঁর গেরিলা জীবন কাটিয়েছেন তা অতুলনীয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হবার অব্যবহিত পরেই শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা) গেরিলা জীবনে চলে আসতে বাধ্য হন। তার অব্যবহিত পরেই বর্তমান পার্টি (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা ’৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধৃত হলে তিনি পার্টির সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হন। গেরিলা জীবনের শুরুতে এম এন লারমা একজন পরিবেশবাদী এবং জুম্মদের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সমগ্র পার্টিতে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুশীলনে তিনি মনোনিবেশ করেন। কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংশ্লিষ্ট জুম এলাকার চারিদিকে অপ্রয়োজনে বন ধ্বংস করতে দিতেন না।

অপরদিকে বনের জীব বৈচিত্র্যতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণি এবং পশুপক্ষী শিকার করতে মানা করতেন। তাঁর এসব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একজন গেরিলা এবং পরিবেশবাদী হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ। আদিবাসী জুম্মদের জীবনযাত্রা এমনিতে বনজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তদুপরি জুম চাষ থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি নির্মাণ, জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ এবং আসবাবপত্র বানানো ইত্যাদির জন্য আদিবাসী জুম্মরা অধিকাংশই বনজ সম্পদ ব্যবহার করে। তাছাড়াও শুধুমাত্র জুম চাষ করে আদিবাসী জুম্মদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। পণ্য উৎপাদন প্রণালীর এই যুগে জীবন-জীবিকার তাগিদে জুম চাষের পাশাপাশি শিল্প কারখানার কাঁচামাল হিসেবে গোলাক বেত, মরিচা বেত, কুরুক পাতা ইত্যাদি বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং বিপনন কাজে তাঁরা বছরের সিংহভাগ সময় নিয়োজিত থাকে বনে জঙ্গলে।

আদিবাসী জুম্মরা যাতে বনজ সম্পদ বিক্রি করে ন্যায্য মূল্য পায়, তার প্রতি দৃষ্টি রাখার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম কাট্টন্যা সমিতি গঠিত হয়েছিলআশির দশকে। বিরল প্রজাতির বন্য প্রাণি সুরক্ষার বিষয়টা দেখাশুনার ভারও ন্যস্ত করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম কাট্টন্যা সমিতির উপর। প্রাচীনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শকুন, রঙরাঙ, মোনদুর (পার্বত্যাঞ্চলের এক প্রকার বড় আকারের কচ্ছপ), ইয়্যা হরিণ (উচুঁ পর্বতের গায়ে বিচরণক্ষম বিশালকায় হরিণ) ইত্যাদি প্রজাতির প্রাণি এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাদের অবশেষাংশ হলেও সুরক্ষার জন্য তিনি সময় সময় পার্টিকে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতেন। তাঁর পরিবেশবাদিতার আরেকটা প্রণিধানযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে মোনদুর অবমুক্তকরণ।

একদা আমাদের ব্যারাকের পাশের জুমচাষীদের ওখানে রোগী দেখতে গিয়েছিলেন, ডাক্তার সুমেন্তু (পরবর্তীতে ডাঃ লেক্সি)। ডাক্তার ছিলেন বেশ বেটে। সে যখন কচ্ছপটাকে ক্রয় করে ব্যারাকে পিঠে করে আনছিল তখন পিছনের দিক থেকে দেখলে শুধু কচ্ছপের পিঠ দেখা যায়। তাকে দেখা যায় মাত্র তার দুটো পা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন কচ্ছপটা মানুষের মতো করে হেটে যাচ্ছে। এভাবে ব্যারাকে পৌঁছলে শ্রদ্ধেয় এমএনলারমা কালবিলম্ব নাকরে কচ্ছটাকে না কেটে ছেড়ে দিতে বললেন। আর কচ্ছপও মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে গজেন্দ্র গমনে এমন হাটা শুরু করে দিয়েছে, আমাকে (লেখক) পর্যন্ত অনায়াসে পিঠে করে নিয়ে যায় এমন অবস্থা। শেষে কচ্ছপটাকে কাটার বদলে তার পিঠে সন-তারিখ লিখে পাকঘরের ছোট ছড়ার উজানে ছেড়ে দিয়ে আসতে হলো কালবিলম্ব না করে।

কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন জুম চাষীদের প্রত্যেকটি বিষয়ে তিনি নিখুঁতভাবে জেনে নিতেন। প্রথমতঃ জুম এলাকা নির্ধারণ, দ্বিতীয়তঃ তাদের বীজ ধান, তৃতীয়তঃ চাষের মৌসুমে তাদের খোরাকি ব্যবস্থা এবং জুম চাষের প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম চাষীদের মধ্যে অধিকাংশই গরীব, যারা জুম কেটেও কোনো কোনো সময় ফেলে রাখে। পুঁজির অভাবে তারা ঠিক সময়ে জুম চাষ করতে পারেনা। অথবা জুম পুড়েও খোরাকি এবং বীজধানের সংকটের কারণে যথাসময়ে জুমে ফসল বুনতে পারে না। এভাবে প্রতিবছর বিনাচাষে অনেক জুমচাষীর শ্রম নষ্ট হয় আর ধ্বংস হয় বন। তাই জুমচাষের মৌসুমের আগে জুমচাষী পরিবারদের পরিসংখ্যান নেয়ার পরামর্শ দিতেন প্রতি বছর। এইভাবে যোগাযোগের মধ্য দিয়ে জুম্মদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দিক নির্দেশনা দিতেন। এই জুম চাষীরাই ফি বছর কেন্দ্রীয় কার্য়ালয়ের জন্য বাজারের ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রেরিত জিনিষপত্র ব্যারাকে পৌঁছে দিতো।

১৯৭৯ সালের শেষ দিকে শত্রুর তৎপরতা বেড়ে গেলে আমাদেরকে আবারো নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হয়, জুম চাষীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। তখন জুমের ধান উঠে গেছে। তিল আর কার্পাস তোলার মৗসুম। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় জুমে তিল, কার্পাসের গাছ দুলছে। শোনা যায় তং ঘরের বাঁশের চোঙায় ভীমরুলের গুঞ্জরণ, এসব জানান দিচ্ছে শীতকালের আগমনী বার্তা। সে সময় হঠাৎ এক ফসলা মৌসুমী বৃষ্টিতে সদ্য ফোটা জুম্ম সূতোর গোলা মাটিতে ঝড়ে পড়েছে। সাথে সাথে ইঁদুর সেগুলোকে গর্তের ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে গুচ্যা ঠাকা (তিল গাছের গুচ্ছ) গুলোতে প্রতিদিন বানরের উৎপাত শুরু হয়ে গেছে। বানর তাদের চোখ দুটো বন্ধ করে দুই চোখের গর্তে তিলের ঠাকা থেকে তিল ঢেলে গর্ত ভরে গেলে পরে, মুখে পুড়িয়ে মোছা করে আস্তে আস্তে খায়। এইভাবে সব তিল বানরের উদরস্থ হবার উপক্রম হয়েছে। আমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছি সেটা ছিল জুম চাষীদের এলাকার সবচেয়ে নিরিবিলি দিকটাতে। যেখানে বনের পশুপক্ষীদের আওয়াজ বাদে আর কিছুই শোনা যায়না। এমতাবস্থায় তিনি (নেতা এম এন লারমা) সারাদিন থুরুং নিয়ে আপন মনে কার্পাস সংগ্রহ করতেন। একই সঙ্গে বানরও তাড়াতেন। কিন্তু জুম চাষীদের কারো সাথে কথা বলতেন না। কেবলমাত্র আমরা যেই তং ঘরে থাকতাম সেই তং ঘরের ইজোরে জুম্ম সূতো জমা করে রেখে দিতেন আর মালিকরা এসে সেখান থেকে সুবিধামতো সময়ে তুলে নিয়ে যেতো তাদের নিজ তং ঘরে। জুম চাষীদের মধ্যে (চোগোট্যা বাপ নামে) একজন রসিক লোক ছিলেন। যিনি সবসময় আমাদের সাথে খেয়াল মস্করা করতেন।

তিনি বলতেন, “তোমাদের ঐ লোকটা ভুল নাকি, কথা বলে না।শুধু আপন মনে কার্পাস সংগ্রহ করে আর বানর তাড়ায়। সে না থাকলে এবছর আমরা কার্পাস বা তিল কোনটাই বাড়িতে তুলতে পেতাম না।” যেদিকে বানরের ঝাঁক বেশী সেই অংশে তিনি বানর তাড়াতেন এবং কার্পাস সংগ্রহ করতেন।ঐভাবে তাঁর গেরিলা জীবনের দিনগুলো কেটে গিয়েছিলো। সারাদিন জুমে তিল আর কার্পাস গাছের তলে কাটানোর পর, রাত ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে সেন্ট্রী থেকে রাইফেল টেনে নিয়ে সেন্ট্রীকে ঘুমোতে দিতেন। কারণ সকাল হলে তাকে আবারো পেট্রলিং-এ বা অন্যান্য কাজে বেরুতে হবে। এভাবে প্রায় তিন চার জন সেন্ট্রীর পালা একাই শেষ করতেন। সকালে যাতে অন্যান্যরা আবারো নূতন উদ্যোগে কাজে বেরুতে পারে সেজন্য তিনি সেটা করতেন। ঘরে-বাইরে তাকে পলিসি নির্ধারণ করতে হতো। একাজে তখন তাঁকে সহায়তা করতেন, বর্তমান আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য শ্রী গৌতম কুমার চাকমা (স. অশোক)। আর অগ্রজ শ্রীঅনাদি রঞ্জন চাকমা (শহীদ অম্বর)। এভাবে ’৭৯ সালটা কাটিয়ে ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি পার্টির বর্তমান সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা কারামুক্ত হলে তিনি পুনরায় কাজে যোগদান করলেন। পার্টি নেতৃত্ব হলো আরো শক্তিশালী। জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পার্টির ভাবমূর্তিতে নূতন মাত্রা যোগ হয়েছিল। যার সবিশেষ উল্লেখ্য পর্যায় হচ্ছে, ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনোত্তর নিয়মতান্ত্রিক আন্দালনের জন্য পার্টির কাঠামো যুগপৎ সাজানো হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছিল সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামব্যাপী পাটির্র শাখা সংগঠন সমূহ। ১৯৯৮ সালের ৩ মার্চ সর্বশেষ অস্ত্র জমাদানের অনুষ্ঠান শেষে পরিবর্তিত শাখা সংগঠনের দায়িত্ব গ্রহণ পর্যায় শুরু হয়। স্থানীয় সেনা জোনকম্যান্ডার থেকে শুরু করে যথারীতি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে সর্বাগ্রে সংযোগ হয়। পর্যায়ক্রমে জেলা থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শাখা সংগঠন সম্প্রসারিত হয়। অতিদ্রুত চুক্তির সুফলের আশায় উৎসুখ জুম্ম জনগণ পার্টি সংগঠন সমূহকে আন্তরিকভাবে প্রফুল্ল চিত্তে সহযোগিতা দিতে এগিয়ে এসেছিল। দেশের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন কলেজ ভার্সিটি প্রাঙ্গনেও দেখা যেতো হাঁসিখুশী ছাত্রজনতার ঢল। চুক্তি বাস্তবায়নের শ্লোগানে মুখরিত পার্বত্য জনপদ। কিন্তু যতই দিন গড়াচ্ছিল ততই এই কলরব স্থিমিত হয়ে আসে। তারপরও এই উৎসব মুখর পরিস্থিতিকে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শহর উন্নয়ন চিত্রে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিখ্যাত জাতীয় নেতা, বীরযোদ্ধা, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য ইত্যাদি শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাস্তাঘাটও সেভাবে সজ্জতি হবে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের সেই স্বপ্নকে সামনে রেখে আমরাও প্রাথমিকভাবে মহান নেতা এম এন লারমার ভাস্কর্যকে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলা শহরে প্রবেশদ্বারে প্রয়াত নেতা এম এন লারমার ভাস্কর্য প্রতিস্থাপন ছিল আমাদের একটি অন্যতম উদ্যোগ। এরকম প্রাণবন্ত উদ্যোগের সাথে সামিল হয়েছেন দেশের নামীদামী জাতীয় নেতৃবৃন্দ। মহান নেতা এম এন লারমা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদের উর্ধে থেকে তাঁর চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। সেজন্য পার্টি শাখাসমূহের প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল আদিবাসী জুম্মজাতি সত্তার জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বকে প্রধান্য দেয়া হয়েছিল। চুক্তি বাস্তবায়নের সকল কর্মসূচিতে সেজন্য সকল আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহের অংশগ্রহণ ছিল উৎসাহব্যঞ্জক।

ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতিসমূহ থেকে যাতে কেউ পিসিজেএসএস এ যোগদান না করে, সেজন্য ১৯৭৯ সালে এবং ১৯৮৯ সালে শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থান্বেষী মহল জুম্ম যুব সমাজকে টোপ ফেলেছিল। প্রলুব্ধ করেছিল নানাভাবে। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালের ১৪ জুন তৎকালীন স্থানীয় জেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে-পরে তদানীন্তন সামরিক শাসক লেঃ জেনারেল এরশাদ সরকার বিভিন্ন বিভাগে কতিপয় জুম্ম যুব নারী-পুরুষকে সহজ পদ্ধতিতে চাকরিতে নিয়োগ প্রদান করে। তারও আগে ১৯৭৯ সালে একদিকে ব্যাপকহারে বহিরাগত সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়। অপরদিকে তথাকথিত সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতি রক্ষার দৃষ্টান্তস্বরূপ, ছিটেফোটাভাবে দলচ্যুত কতিপয় শান্তিবাহিনীর সদস্যকে ছোটখাটো পদে নিয়োগ দান করা হয়েছিল। চুক্তি-উত্তরকালেও শান্তকরণ প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে জেএসএস নেতা ও নেতৃত্বকে উৎখাতের কার্যক্রমে উৎসাহিত করেছে সরকারের বিশেষ মহল। এসব কিছুকে উপেক্ষা করে মহান নেতার চিন্তা-চেতনাকে লালন-পালন করে যাওয়ার মধ্যদিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প কোন পথ নেই। তাই মহান নেতার চিন্তা-চেতনা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।