মহান নেতা এম এন লারমাঃ তাঁর চিন্তা ও কর্ম

0
738

সজীব চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, যিনি এম এন লারমা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি ছিলেন একজন জনদরদী ও পথিকৃৎ সাংসদ। এটাও সত্য যে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পুরনো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথিকৃৎ, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের প্রথম রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নেতা। তিনিই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের জন্য দাবি জানান। এক পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ, সরল, নিরীহ মানুষ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়।

বলাবাহুল্য, অধিকার আদায়ের জন্য এম এন লারমা প্রথমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন, ন্যায্য অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায় করতে চেয়েছিলেন। তিনি কখনোই যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ করতে যাননি। তাই তিনি প্রথমেই লিখে, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে, সাংসদ হয়ে আলাপ-আলোচনা করে, গণতান্ত্রিকভাবে মানুষকে সংগঠিত করে এবং সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করে, যুক্তি উপস্থাপন করে দাবি আদায় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আর তিনি কখনো তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করেননি। তা না হলে তিনি সরকারের কাছে রাষ্ট্রের অখন্ডতা স্বীকার করে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া করতেন না, এজন্য আবেদন নিবেদন করতেন না। সংসদ সদস্য হয়ে দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য সংসদে এত দরদ দিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন না। তিনি বাংলাদেশের মধ্যেই এবং বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাইবোনদের সাথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে জুম্ম জনগণের জন্য স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ১৯৭২ সালে পেশকৃত বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের শাসনতান্ত্রিক অধিকার দাবির আবেদনপত্রের উপসংহারে লিখেছিলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ এখন মুক্ত। ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ভেঙে গেছে। এখন আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ চারটি মূলনীতি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে উর্ধ্বে তুলে ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের ভাইবোনদের সাথে একযোগে এগিয়ে যেতে চাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ মনে করে এবং বিশ্বাস করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের যুগ যুগান্তরের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তুলে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের সংরক্ষণের অধিকার দেবেন।’

জুম্মদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করলেও এম এন লারমা বাঙালি বিদ্বেষী বা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তাই তাঁর নিয়মতাান্ত্রিক আন্দোলন, এমনকি সশস্ত্র আন্দোলনও প্রকৃতপক্ষে বাঙালির বিরুদ্ধে ছিল না। বরঞ্চ, কলেজ জীবন থেকে সংসদীয় জীবন পর্যন্ত তাঁর বরাবরই বাঙালি বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্টতা ছিল। কাপ্তাই বাঁধ এর ব্যাপারে বিরোধীতার জন্য কারাভোগের পর ১৯৬৫ সালের মার্চ মুক্তি লাভ করলে সেদিন জুম্মরা সংবর্ধনার জন্য আসতে পারেনি। বরং বাঙালি বিপ্লবী বন্ধুরাই চট্টগ্রামের জেএমসেন হলে তরুণ ছাত্রনেতা এম এন লারমার সম্মানে বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করে। জানা যায়, অকৃত্রিম এই মানুষটি জুম্মদের স্বাধিকারের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে একমত না হতে পারলেও এবং নানা বিতর্কে অবতীর্ণ হলেও তিনি রাঙ্গামাটি থাকা অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন তখন তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন এবং নীরবে চোখের পানি ফেলেছিলেন।

এম এন লারমা সাধারণ বা গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন গভীর মানবিকবোধসম্পন্ন এক বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা। তিনি কেবল সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য বা নিজের বা কোন গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করেননি। সমাজের বা সমাজের মানুষের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্যই রাজনীতি করেছেন। পশ্চাদপদ সামন্ততান্ত্রিক জুম্ম সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন সাধনের জন্যই রাজনীতি করেছেন। বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা বলেই তিনি কেবল ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়া নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি। সমাজ, সংস্কৃতি, পরিবেশ, জীবজগত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন।

মানুষ চিন্তা করে বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবনের বাইরে মানুষ, জাতি, জীবন ও জগত, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তাশীল মানুষ ক’জন পাওয়া যায়? আর অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো, ন্যায়নিষ্ঠ ও সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠা করবো- এমন চিন্তার অধিকারী মানুষতো বরাবরই অল্প। কাজেই কোন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা সহজ কাজ নয়। আর সঠিক চিন্তাধারা আয়ত্ত করা তো আরও কঠিন। সর্বোপরি, সেই চিন্তাধারা কাজে প্রয়োগ করা, অনুশীলন করা, সেই অনুযায়ী আচরণ করা এবং বাস্তবায়ন ঘটানো তো আরও দুরুহ এবং জটিল এক ব্যাপার। এম এন লারমা সেই বিপ্লবী নেতা যিনি সঠিকভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনে তা অনুশীলন করেছিলেন এবং বাস্তব প্রয়োগে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এজন্য তিনি অতুলনীয় ত্যাগের জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।

বর্তমান রচনায় তাঁর চিন্তাধারার কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় এবং কিছু কর্মকান্ড স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে মাত্র। উল্লেখ্য যে, এম এন লারমা বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৩ বছরের একটু বেশী। ক্ষণজন্মা এই বিপ্লবী নেতা তাঁর নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তেমন লেখালেখি করে যেতে পারেননি। বিশেষ করে রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় গেরিলাযুদ্ধের কারণে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হওয়ায় হয়ত লেখালেখি সম্ভব হয়নি। আর যাওবা হয়েছে সেসবও সংরক্ষণ করা কঠিন হয়। কিন্তু বেশ কয়েক বছরের নিরলস নিয়মতান্ত্রিক ও গেরিলা জীবনে অগণিত মানুষ ও সহযোদ্ধা-কর্মীর কাছে রেখে যাওয়া তাঁর নানা কথাবার্তা, উক্তি, পরামর্শ, নির্দেশনা, বক্তব্য এবং তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিজীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতাই আজ তাঁর সর্বশেষ সাক্ষী।

স্বদেশ বা স্বভূমির প্রতি প্রেম এবং স্বজাতির প্রতি প্রেম যে কোনো সভ্য ও ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। স্বদেশ বা স্বজাতিকে লালন, পালন ও সুরক্ষা মানুষের কাছে বীরোচিত এক দায়িত্ব-কর্তব্য। তরুণ বয়স থেকেই এম এন লারমা জন্মভূমির প্রতি ও স্বজাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ অনুভব করতেন। স্বজাতির পশ্চাদপদতায় ও দুর্দশায় ব্যথিত হতেন। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই গ্রামের নেতৃস্থানীয় নারী-পুরুষ বা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে স্বজাতির সমাজ, সংস্কার, রীতি, নীতি, আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি সম্পর্কে মনোযোগ সহকারে জানতে চাইতেন। কাপ্তাই বাঁধের ফলে যে জন্মভূমি ও স্বজাতি বিরাট বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে একমাত্র তিনিই তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এজন্য তিনি সেই তরুণ বয়সেও তৎকালীন স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের আমলে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে লিফলেট লিখে ছাপিয়ে বন্ধুদের সহায়তায় প্রচার করেছিলেন এবং এজন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়।

কাপ্তাই বাঁধের দরোজা বন্ধ করার সাথে সাথে ধীরে ধীরে যখন গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যাচ্ছিল এবং এক পর্যায়ে এম এন লারমাদের বাড়িও গ্রাস করতে শুরু করল, ঠিক তখনি এম এন লারমা বাড়ির দেয়াল থেকে এক খন্ড আর উঠোন থেকে আরেক খন্ড মাটি তুলে আনলেন। পরে সেই মাটি কাগজে ভালোভাবে মুড়িয়ে দিদি জ্যোতিপ্রভা লারমার কাছে দিলেন এবং বললেন, এই মাটি অমূল্য জিনিস। তিনি ব্যক্তিগতভাবে কারও সাথে ঝগড়া-বিবাদ করতেন না। কিন্তু কেউ যদি স্বজাতির নামে অসম্মানজনক ও অবজ্ঞাসূচক কথা বলতো তাহলে তার প্রতিবাদ না করে থাকতে পারতেন না। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তিনি স্বজাতির কথা ভাবতে ভূলে যাননি। ঘাতকদের অতর্কিত হামলায় প্রথম দফায় তিনি আহত হয়ে পড়েছিলেন। ঘাতকদের কয়েকজনকে সামনে পেয়ে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, ‘কি তোমাদের ক্ষমা করে আমরা অন্যায় করেছি? আমাকে কিংবা তোমাদের বন্ধুদের মেরে জাতি কি মুক্ত হবে? যাক, তোমরা প্ররোচিত ও উত্তেজিত হয়ে যাই করো না কেন জাতির দুর্দশাকে তোমরা কখনো ভুলে যেও না, আর জাতির এ আন্দোলনকে কখনো বানচাল হতে দিও না।’

এম এন লারমাই প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি জোরালোভাবে তুলে ধরেন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে এবং বাংলাদেশ খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বরাবরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বরাবরে লিখিত স্মারকলিপিতে তিনি বলেন, ‘বছরকে বছর ধরে ইহা একটি অবহেলিত শাসিত অঞ্চল ছিল। এখন আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে গণতান্ত্রিক পৃথক শাসিত অঞ্চল অর্থাৎ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বাস্তবে পেতে চাই।’ এতে আরও বলেন, ‘জনগণের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে পৃথক শাসিত অঞ্চলের সত্বা যথেষ্ট নয়। ইহা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্বের নিরাপত্তাবোধ এনে দিতে পারেনি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা যাবে না।… সুতরাং- ক) আমরা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সত্বেও পৃথক অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পেতে চাই। খ) আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার থাকবে, এরকম শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন চাই। গ) আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষিত হবে এমন শাসন ব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঘ) আমাদের জমি স্বত্বা জুম চাষের জমি ও কর্ষণযোগ্য সমতল জমির স্বত্বা সংরক্ষিত হয় এমন শাসন ব্যবস্থা আমরা পেতে চাই। ঙ) বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল হতে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেন কোনো বসতি স্থাপন করতে না পারে তজ্জন্য শাসনতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার প্রবর্তন চাই।’ বস্তুতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের স্বকীয় সংস্কৃতি, জন্মভূমির অস্তিত্ব ও জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এই দাবি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবি। পরবর্তীতে স্বায়ত্তশাসন সম্বলিত এই দাবির ভিত্তিতেই জনসংহতি সমিতিও তার আন্দোলন পরিচালনা করে এবং সংলাপ চালায়।

তিনি সংসদের ভেতরে ও বাইরে বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসন আদায়ে ছিলেন সদা সোচ্চার। পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসন কাঠামো এবং জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্টের প্রেক্ষাপটে সংবিধানে সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। তিনি ১৬ সদস্যের এক জুম্ম প্রতিনিধিদল নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেন। এছাড়া তিনি ২ নভেম্বর ১৯৭২ সংবিধান বিলে ‘৪৭ক’ নামে এক নতুন অনুচ্ছেদের সংযোজনী প্রস্তাব এনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। উক্ত সংযোজনী অনুচ্ছেদে তিনি প্রস্তাব করেন যে- ‘৪৭ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল একটি উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হইবে।’

এই প্রস্তাবের পক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি সেদিন গণপরিষদে ঐতিহাসিক যুক্তি তুলে ধরেন। সেসময় গণপরিষদে একমাত্র তিনিই ছিলেন নির্দলীয় ও অ-আওয়ামীলীগ সদস্য। তবু কোনরূপ ভয়ভীতিকে তোয়াক্কা না করে অকুতোভয় চিত্তে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন-

‘মাননীয় স্পীকার সাহেব, পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা দশটি ছোট ছোট জাতি বাস করি। চাকমা, মগ (মারমা), ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরং ও চাক- এই দশটি ছোট ছোট জাতি সবাই মিলে আমরা নিজেদেরকে ‘পাহাড়ী’ বা ‘জুম্ম’ জাতি বলি।…ব্রিটিশ বাংলাদেশকে শাসনের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ-এ ‘চিটাগং হিল ট্রাক্টস রেগুলেশন’-এর মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক- সবকিছু দেখাশুনার ভার বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেয়। …১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ভারত শাসন আইনে আবার পার্বত্য চট্টগ্রামকে ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের ‘চিটাগং হিলট্রাক্টস রেগুলেশন’ দ্বারা পরিচালনা করার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারপর ব্রিটিশ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পুনর্বার পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঐ রেগুলেশনের দ্বারা শাসন করার স্বীকৃতি প্রদান করে। তারপর পাকিস্তানের সময়ও ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত- প্রথম সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত- সেই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারাই পরিচালনা করা হয়। তারপর ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধান এবং স্বৈরাচারী আইয়ুবের ১৯৬২ সালের সংবিধানেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঐ রেগুলেশনের দ্বারা শাসিত এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।…’

কিন্তু সেদিন এম এন লারমার কোন যুক্তি বা ঐতিহাসিক ভিত্তি কোনটাই তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর মনে দোলা দিতে পারেনি। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতায় জুম্ম জনগণের সকল ন্যায্য দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। কিন্তু দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ, সকল জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার সুনিশ্চিত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি সময়ের দাবিতে বর্তমানে আরও বেশী জরুরি হয়ে পড়েছে।

১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১ নং ধারায় বিধান করা হয়েছে যে, ‘উভয় পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করিয়া এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করিয়াছেন।’ এই অঞ্চলের আদিবাসী জুম্ম (উপজাতি) অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অন্যতম জরুরি বিষয় হচ্ছে এসব জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।

বহু জাতির সমাহারেই মানবজাতি। তাই মানবাধিকার ঘোষণায় সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। বস্তুতঃ আধুনিক যুগে জাতীয়তাবোধহীন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু প্রত্যেক জাতিই তাঁর স্বকীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতিনীতি নিয়ে বাঁচতে ও বিকশিত হতে চায়। বস্তুতঃ এটাই হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জাতীয় বিকাশের পথ। একটি জনগোষ্ঠীর মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের পথে যেতে গেলে জাতীয় বিকাশের পথে, জাতীয়তাবাদের পথে এবং জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পথেই যেতে হয়। বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিকাশের পথ এই জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পথে তথা সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রের পথে যেতে হয়েছে। তবে, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বা জাতীয়তাবাদের বিকাশের জন্য সার্বভৌম রাষ্ট্র সবসময় অপরিহার্য নয়। সামন্তবাদ কখনো জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটাতে পারে না। এমনকী জাতীয়তাবাদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই জাতীয়তাবাদ বিকাশের জন্য, একটি জাতির বিকাশের জন্য সামন্তবাদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করতে হয়, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়, জাতীয় সংগঠন সংগঠিত করতে হয়। বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বা দুটি জাতিগোষ্ঠী নয়, ডজনখানেক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের রয়েছে প্রত্যেকের স্বকীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য। এইগুলি অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ সামন্তবাদের দ্বারা আকন্ঠ নিমজ্জিত। সামন্তবাদ সবসময়ই নিজেকে নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়, বৃহত্তর সামাজিক প্রগতিতে এগিয়ে আসতে চায় না। তাই সামন্তবাদ কখনোই এই ভিন্ন ভিন্ন জাতিগুলিতে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি করতে পারেনি এবং শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। অপরদিকে বিভিন্ন বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী বরাবরই এই জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতি অবলম্বন করে এসেছে। এই জাতিগোষ্ঠীগুলোকে এম এন লারমাই জাগরিত করেন, ঐক্যবদ্ধ করেন এবং জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত করেন।

এম এন লারমাই জুম্ম জাতীয়তাবাদের স্থপতি এবং জুম্ম জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক। জুম্ম জাতীয়তাবাদী হতে গেলে এবং জুম্ম জাতীয়তাবাদ বিকশিত করতে গেলে কী করতে হবে তাও যেন তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের মধ্য দিয়ে। তবে এটা স্মরণ রাখতেই হবে যে, জুম্ম জাতীয়তাবাদও জাতীয়তাবাদ বটে, কিন্তু এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়, উগ্র জাতীয়তাবাদও নয়, এমনকী পুরনো ধারার একক জাতি, ধর্ম বা শ্রেণির কোন জাতীয়তাবাদও নয়। বস্তুতঃ এ এক বহু জাতির, বহু ধর্মের, বহু শ্রেণির সম্মিলিত এক জাতীয়তাবাদ; দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র ও বৃহৎ শক্তির দ্বারা অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত একাধিক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদ এবং সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু কিংবা অগ্রসর-পশ্চাদপদ প্রত্যেক জাতি বা জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকার করে, সহযোগিতা করে এবং প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে সমান বিবেচনা করে সংহত এবং সংগঠিত হয়ে স্বাধিকার আদায়ে সংগ্রামরত একাধিক জাতিগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদ। ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ঐতিহ্যগত ভিন্নতা এবং শিক্ষাগত ও অথনৈতিক তারতম্য সত্বেও, সর্বোপরি ভাষাগত, সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও যে একাধিক জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং একই সাধারণ জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে জুম্ম জাতীয়তাবাদ তারই এক উদাহরণ। বস্তুতঃ জুম্ম জাতীয়তাবাদ, প্রগতিশীল ধারার এক জাতীয়তাবাদ। পৃথিবীর জাতিতে জাতিতে যে দ্বন্দ্ব, সমস্যা তাঁর সমাধানও যেন জুম্ম জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় সূত্রবদ্ধ রয়েছে।

এম এন লারমার চিন্তাধারার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিপীড়িত, বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম দরদ। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ এর ভাষায় ‘যে কোন সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করেছেন মানবেন্দ্র লারমা।’ গরীব চাষী ও ভূমিহীন তথা সমাজে যারা সবচেয়ে গরীব ও অসহায়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাদের সকলের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী দয়াশীল। দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তিনি অত্যন্ত উৎকন্ঠিত থাকতেন। তাই তিনি যেখানে গেছেন সেখানে অসহায় গরীবদেরকে সীমিত সাধ্যের মধ্যেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মীরা আসলে তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন। সহযোদ্ধাদের সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিতেন। একবার পাহাড়ি জুম বেয়ে পথ চলতে চলতে জীর্ণশীর্ণ এক ত্রিপুরা জুম চাষীকে দেখতে পেয়ে সহযোদ্ধাদের দেখিয়ে বললেন, ‘ভাতের অভাবে তাকে মনে হয় এমন দেখাচ্ছে। যাও তাকে কিছু দিয়ে এসো।’ তখন তাঁর রুখসেক থেকে ৩০০ টাকা বের করে এক সহযোদ্ধার হাতে দিয়ে ঐ চাষীকে দিয়ে দিতে বললেন এবং পরে অসুবিধায় পড়লে সে যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে সে কথাও জানাতে বললেন। এমনকি গেরিলা জীবনে কোন জুমের কাছাকাছি থাকার সময় নিজের পরিশ্রম দিয়েও জুমিয়া পরিবারকে সহযোগিতা করেছেন। বলাবাহুল্য, জনসংহতি সমিতির সার্বক্ষণিক কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর অথবা স্বল্প শিক্ষিত। তিনি এদেরকে নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা-ভাবনা করতেন। দলীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি এদের জন্য পার্টিতে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেন। তিনি নিজে এসব সহকর্মীদের লেখাপড়া শেখাতেন এবং রাজনৈতিক ক্লাশ পরিচালনা করতেন। তিনি শুধু জুম্ম সাধারণ মানুষের কথা বলেননি, নিপীড়িত, নির্যাতিত বাঙালির অধিকারের কথাও বলেছেন। তিনি যখন সাংসদ ছিলেন, তখন সংসদে তিনি দেশের শ্রমিক, কৃষক, রিকশাওয়ালা, মেথর, জেলে ইত্যাদি মেহনতী মানুষের অধিকারের কথা, সংবিধানে তাদের অধিকার বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে দরদ দিয়ে তুলে ধরেছেন।

সাংসদ হিসেবেও এম এন লারমা ছিলেন অত্যন্ত সরব এবং অনুকরণীয়। বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘মানবেন্দ্র লারমা চমৎকার বাংলায় বক্তৃতা দিতেন। সংসদে বিরোধী দলের কন্ঠ বলতে তখন আতাউর রহমান খান, ভাসানী ন্যাপের সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালেহ উদ্দিন, আব্দুল্লাহ সরকার, কুমিল্লা থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচিত আলী আশরাফ এবং মানবেন্দ্র লারমাকেই বোঝাতো। সরকারি দলের সাংসদদের চেয়ে তাঁদের বক্তব্যকেই সাংবাদিকরা বেশী মূল্য দিতেন। তাঁরা কক্ষে কিছু বললেই সেটা সংবাদ হতো।’ সৈয়দ মকসুদ আরও লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উপস্থিতিতে তিনি পার্বত্য জনগণের নানা সমস্যার কথা ও দাবিদাওয়া কঠোরভাবে উপস্থিত করতেন, পার্লামেন্টে যেমন হওয়া উচিত। আবার অধিবেশনের পরে বারান্দায় বা করিডোরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হাস্য-রসিকতাও করতেন। আমার কষ্ট হয়, তাঁর রাজনীতি ভিন্ন পথে না গেলে তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে একজন বড় ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হতে পারতেন। সে যোগ্যতা তার পুরোপুরি ছিল।’ এখানে উল্লেখ্য যে, সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সংসদে তিনি কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের স্বায়ত্তশাসনের দাবির কথা তুলে ধরেননি, গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা, বাংলাদেশের মাছ, যুদ্ধবন্দী বিচার, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বিল, ১৯৭৩, রেলওয়ে বাজেট, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষী, ব্যাংক ডাকাতি, বাজেটের উপর সাধারণ আলোচনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাকা ও কাঁচা রাস্তা, কর্ণফুলীতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ, পল্লী বিদ্যুতায়ন, পাকশী কাগজের কল, বেতারে বিরোধী দলীয় মতামত প্রকাশের সুযোগ, জাহাজ থেকে ঢেউটিন আত্মসাৎ, আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ, মেডিকেল কলেজ ও অধ্যাপক, ভবঘুরে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা উন্নয়ন, শিক্ষক কল্যাণ ভাতা, বনজ সম্পদের উন্নয়ন, হাসপাতাল, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ামসহ দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আলোচনা ও প্রস্তাব রেখেছেন।

বাংলাদেশে ও সংসদে গণতন্ত্রায়ন, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। সংসদে প্রথমে কেবল পবিত্র কোরান ও গীতা থেকে পাঠ করা হতো। তিনিই প্রথম বহুধর্মের দেশ ও ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ বাংলাদেশের সংসদে কোরান ও গীতা পাঠ হলে, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক ও খ্রিস্টানদের বাইবেল থেকে পাঠ হবে না কেন এই প্রশ্ন তোলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল এই প্রসঙ্গে সংসদে তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পীকার, শপথ গ্রহণের আগে আমাদের দিনের কর্মসূচী যখন আরম্ভ হয়েছে, তখন পবিত্র কোরান থেকে ‘সুরা’ পাঠ এবং গীতা থেকে শ্লোক পাঠ করা হয়েছে। এখন আপনার মাধ্যমে এই পরিষদের নিকট আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, এই পরিষদে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক প্রতিনিধিত্ব করছি। বাংলাদেশে শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা শুধু ইসলাম-ধর্মাবলম্বী লোক নাই- বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী লোকও আছেন। মাননীয় স্পীকার এখন আমার প্রশ্ন হল যে, কেবল পবিত্র কোরান পাঠ এবং গীতা পাঠ করা হবে, না বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ত্রিপিটক এবং খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বাইবেল থেকেও পাঠের প্রয়োজন আছে?’ এম এন লারমা এই প্রশ্ন তোলার পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগতভাবে লারমার যুক্তি স্বীকার করেন এবং ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকেও পাঠ করা হবে বলে আশ্বাস দেন।

১৯৭৩ সালের জুন মাসে আবার অধিবেশন বসলে সেখানে যখন আবার ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হল না, তখন তিনি আবার বিষয়টি উত্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন শুরু হলে, তাতে কোরান, গীতা ও ত্রিপিটক থেকে পাঠ হলেও বাইবেল থেকে পাঠ বাদ দেয়া হলে আবারও তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন এভাবে- ‘আজকে এই মহান জাতীয় সংসদে পবিত্র কোরান তেলাওয়াত, গীতা পাঠ এবং ত্রিপিটক পাঠ হল বটে কিন্তু খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বাইবেল থেকে পাঠ করা হল না কেন? খ্রীষ্টানরাও বাংলাদেশের নাগরিক।..বাংলাদেশের খ্রীষ্টান নাগরিকদেরও জাতীয় সংসদে ধর্মীয় অধিকার রয়েছে।’ এভাবে সংসদে বৌদ্ধদের ত্রিপিটক ও খ্রিস্টানদের বাইবেল পাঠ শুরু হল। সত্যিকারের নিঃস্বার্থ, বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংসদ বলেই এসব সম্ভব হয়েছে।

এম এন লারমার চিন্তাধারার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল- তাঁর পরিবেশগত চেতনা, পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে তাঁর চিন্তাধারা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে গভীর উপলব্ধি। প্রকৃতির প্রতি একদিকে ছিল তাঁর সহজাত প্রেম, অপরদিকে মানুষের প্রয়োজনে প্রকৃতিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ পরিমিতিবোধ। অপ্রয়োজনে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। আজকে দেশে দেশে, এমনকী বৈশ্বিকভাবে যেভাবে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিষয়টি উঠে আসছে অথবা মানুষ অস্তিত্বের প্রয়োজনে বিষয়টি তুলতে বাধ্য হচ্ছে, তাতে আমাদের এম এন লারমার কথাই স্মরণে আসে। আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের যে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক পরিবেশের যে অবনতি, বিভিন্ন প্রজাতির যে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, কয়েক প্রকার মৎস্য প্রজাতির দ্রুত অবলুপ্তি, এককালে চঞ্চল ঝিরি-ঝর্ণাগুলোর যে আজকে শুকিয়ে মরার অবস্থা, তাতে এম এন লারমাকে স্মরণ না করে পারা যায় না।

অনেক আগে সার্বিকভাবে পশ্চাদপদ এক সমাজে থেকে এবং প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ ও সমৃদ্ধ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকেও তিনি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ে কত সংবেদনশীল ও বৈজ্ঞানিক চেতনায় ঋদ্ধ ছিলেন! কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী না থাকলেও তিনি এ বিষয়ে কত দূরদর্শী ও পথিকৃৎ ছিলেন! অপ্রয়োজনী গাছ-বাঁশ তিনি কাটতে দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘এ সব আমাদের জাতীয় সম্পদ। তাছাড়া গাছ-বাঁশ প্রকৃতির শোভা যেমনি বৃদ্ধি করে, তেমনি আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে।’ তাই কোন কারণে জঙ্গলে ঘুরতে গেলেও অহেতুক গাছ-বাঁশ না কাটার নির্দেশ দিতেন তিনি। দুর্লভ পশু-পাখি বধ করা ছিল নিষিদ্ধ। এটা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্টিগতভাবে নির্দেশ জারী করা হয়। ‘ধনেশ পাখি, বিরল প্রজাতির পাখি, মাদি হরিণ, বাঘ, ভল্লুক, গয়াল, হাতী, অজগর, গোখরা সাপ, শকজোর (বিষধর বড় সাপ), বানর, জঙ্গলী কুকুর, বিরল প্রজাতির কচ্ছপ, বনরুই, ইয়ো হরিণ (খাড়া পাহাড়ে থাকা এক প্রকার হরিণ) ইত্যাদি পশুপাখি সংরক্ষণ করার নির্দেশ পার্টির বিভিন্ন গ্রাম কমিটি ও প্রশাসনিক কমিটিতে পাঠানো হয়। তা অমান্য করলে শাস্তির বিধানও রাখা হয়।

কোনো একটা এলাকায় মোটা সূতার জাল দিয়ে পশু শিকার করাও নিষিদ্ধ করা হয়। তবে, পশুদের মধ্যে কেবলমাত্র শুকর শিকারের উপর কোন বিধি-নিষেধ ছিল না। কারণ, প্রথমতঃ শুকরের বংশবৃদ্ধির হার বেশী। দ্বিতীয়তঃ শুকর জুম ও জমির ফসল বেশী নষ্ট করে। ব্যারাক জীবনে তাঁর বিছানার কিছু দূরে অবস্থান নেয়া এক বিষধর সাপকেও তিনি মারতে দেননি। বলেছিলেন, ‘সাপকে ক্ষতি বা আঘাত না করলে বা ভয় না দেখালে সাপ সহজে কাউকে কাটে না। সাপ আপনি থেকেই চলে যাবে।’ মাতৃজাতীয় কোন জীবজন্তুও তিনি শিকার করতে দিতেন না। একবার মাছ ধরতে গিয়ে পাওয়া গেল প্রচুর ব্যাঙাচির আস্তানা। সকলের প্রয়োজনীয় পরিমাণ ব্যাঙাচি ধরার পর তিনি আর ব্যাঙাচি ধরতে বারণ করলেন। শান্তিবাহিনীর সদস্যরা রাত্রে গমনাগমনের সময় ছড়াপথে কাঁকড়া ধরে দাঁড়গুলো ভেঙে কাঁকড়াগুলো ফেলে রেখে দাঁড়গুলো নিয়ে যেত এবং ব্যারাকে পৌঁছে আগুনে পুড়ে শাঁসগুলো খেত। এম এন লারমা তাও বারণ করতেন এবং বলতেন, ‘তোমাদের হাতগুলো কেটে নিলে তোমরা কিভাবে আহার করবে?’ তাছাড়া রাতের বেলায় একই জায়গায় ঘন ঘন কাঁকড়া ধরতে বারণ করতেন। রাতের বেলায় কাঁকড়াগুলো গর্তের বাইরে আসে বলে সহজে মানুষের হাতে ধরা পরে এবং কয়েক দিনের মধ্যে ঐ ছড়ায় আর কাঁকড়া পাওয়া যায় না। কোন কীটপতঙ্গ যদি অসহায় হয়ে পড়ে থাকে তাহলে তিনি সেটা তুলে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে দিতেন।

একবার এক জুমচাষী কচ্ছপ পেলে সন্ধ্যায় তা বিক্রি করতে বের হয়। এ সংবাদ শুনে ব্যারাকের শান্তিবাহিনীর এক সদস্য তা কিনতে সেখানে উপস্থিত হয়। এই কচ্ছপের খবর এম এন লারমার কানে গেলে টর্চ নিয়ে তিনিও সেখানে উপস্থিত হন। তিনি কচ্ছপটি ভালোভাবে দেখে বলে উঠলেন, ‘দেখ দেখ কচ্ছপটি কাঁদছে। এ রকম কচ্ছপ তো এখন পৃথিবীতে বোধ হয় খুব কমই দেখা যায়। আমাদের দেশে এরকম কচ্ছপ আছে তা আনন্দের বিষয়। এদের বংশ মনে হয় কমে যাচ্ছে।’ এক পর্যায়ে তিনি কচ্ছপটি ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। অন্যদেরও আর তাঁকে সমর্থন না করার জো থাকল না। জুম্মদের প্রধান পেশা জুম চাষের জন্য জুম পোড়াবার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সচেতন। প্রয়োজনাতিরিক্ত জঙ্গল কাটা ও পোড়ানোতে ছিল তাঁর বারণ। বাতাসের গতি দেখে এবং সবাই মিলে জঙ্গল পোড়ানোর নির্দেশনা দিতেন।

জুম্মদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এম এন লারমাই অবিসংবাদিত নেতা, আধুনিক ও প্রগতিশীল মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের এক মূর্ত প্রতীক। জুম্মদের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশী। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল, ভদ্র, দয়ালু, ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল, পরোপকারী, কষ্ট সহিষ্ণু, পরমতসহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক, ক্ষমাশীল। তিনি ছিলেন সবসময় ঐক্যের পক্ষে, তাই তো তিনি বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত জুম্ম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দলের মধ্যেও তিনি ঐক্যের পক্ষে ছিলেন। অথচ বিভেদপন্থী, অপরিণামদর্শী, ক্ষমতালিপ্সু চার কুচক্রীরা দুরদর্শী, নির্ভরযোগ্য, অকৃত্রিম মানবপ্রেমের অধিকারী, জুম্ম জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এই মহান নেতাকেই হত্যা করল। তাদের এই হত্যাকান্ড আজ ধিকৃত, ঘৃণিত। আর এম এন লারমা অবিস্মরণীয়, বরণীয়, অমর হয়ে থাকবেন আরও দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ। মহান নেতা এম এন লারমা, লও লও লাল সালাম।