ভূষণছড়া গণহত্যার ৪১ বছর: যে গণহত্যার বিচারও এখনো হয়নি

হিল ভয়েস, ৩১ মে ২০২৫; বিশেষ প্রতিবেদক: দিনটি ছিল ১৯৮৪ সালের ৩১ মে অর্থাৎ আজকের এই দিনে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘটিত হওয়া অন্যতম এক ভয়াবহ গণহত্যা। যা ভূষণছড়া গণহত্যা নামে পরিচিত। এই গণহত্যায় ৪০০ এর অধিক জুম্ম মারা যায়। প্রায় ৭,০০০ জুম্ম মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশয় নিতে বাধ্য হন। আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে ভূষণছড়া গণহত্যা উপরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভূষণছড়া হত্যাকাণ্ডে ৬৭জন আদিবাসী মৃতের তালিকা পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে ২১ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে।’

সেই সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় হাজার হাজার জুম্মদের ভূমি বেদখল করে প্রায় ৫০০টির অধিক বাঙালি পরিবারকে বরকল উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম যেমন- গোরস্থান, ভূষণছড়া এবং ছোট হরিণা গ্রামে বসতি স্থাপন করানো হয়। স্থানীয় জুম্ম জনগণের তীব্র বিরোধীতা সত্ত্বেও বাঙালিদের পুনর্বাসন করায় এসব এলাকার পরিস্থিতি থমথমে হয়ে উঠে।

সেই সূত্র ধরে আবারও জুম্মদের ভূমি দখলের জন্য এবং জুম্মদের অস্তিত্ব ধ্বংস করার নীলনকশা হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০৫তম ব্রিগেড এবং বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)’র ১৭তম ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সেটেলার বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে জুম্মদের এ্যাদভরিয়ে, সুগুরিপাদা, গোরস্থান, তারেঙে ঘাট, ভূষণছড়া ও ভূষণবাগ গ্রামগুলোতে একযোগে প্রতিহিংসামূলক এই হামলা চালায় এবং ভয়াবহতম ভূষণছড়া গণহত্যা সংঘটিত হয়।

এ্যাদভরিয়ে গ্রামের এক চাকমা বাসিন্দা আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিবেদনে তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন,”আমার গ্রাম বরকল পুনর্বাসন অঞ্চলের মধ্যে পড়ে, যেখানে বহু মুসলিম বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে। এ কারণে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বদা উত্তেজনা বিরাজ করত। ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মে প্রায়শই সংঘর্ষ হতো এবং মুসলিম বাঙালিরা প্রায়ই হুমকি দিত যে, সেনাবাহিনী এসে আমাদের শিক্ষা দেবে। ৩১ মে হঠাৎ সেনাবাহিনী আসে এবং সঙ্গে ছিল বহু মুসলিম সেটেলোর বাঙালি যাদের মধ্যে কিছু অস্ত্রধারীও ছিল। তারা আমাদের গ্রাম ধ্বংস করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং মানুষ হত্যা করে। আমি নিজ চোখে দুইজন নারীকে ধর্ষণের পর বেয়নেট দিয়ে হত্যা করতে দেখি। আমার এক দূরসম্পর্কের বোন আরতি, তাকেও কয়েকজন সৈনিক ধর্ষণ করে এবং তার শরীর বিকৃত করে বেয়নেট দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। শিশুসহ অনেক মানুষকে কুঁড়েঘরের মধ্যে ফেলে পুড়িয়ে মারা হয়। কিছু মানুষকে প্রকাশ্যে মারা হয়েছিল যার মধ্যে আমিও ছিলাম। আমাদের পাঁচ-ছয়জনকে গাছের ডালে উল্টো করে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়। সম্ভবত আমাকে মৃত ভেবে ফেলে রাখে, তাই বেঁচে যাই। সেই দিনের স্মৃতি এখনো দুঃস্বপ্নের মতো। এখনো মাঝেমধ্যে ঘুম থেকে ঘামে ভিজে জেগে উঠি, যখন সেই দৃশ্য মনে পড়ে সৈনিকরা আমাদের নারীদের গোপনাঙ্গে বেয়নেট ঢুকাচ্ছে। তারা সবাই চিৎকার করে বলছিল, ‘বাংলাদেশে আর কোনো চাকমা জন্মাবে না।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৬৭জন মৃতের যে তালিকা পেয়েছিল সেখানে আরতি চাকমার নাম ছিল। তার বিবরণে বলা হয়, ‘তার বয়স ছিল ২২ বছর, বাস করত এ্যাদভরিয়েতে; ধারালো ছুরি দিয়ে তার স্তন দুটি কেটে ফেলা হয়েছিল। ৬৭জনের মধ্যে নারীর মৃতদেহ ছিল ১১টি যাদের মধ্যে প্রায় সবাই ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল।’

গোরস্থান গ্রামের মৃতের তালিকা ছিল নয়জনের। গোরস্থান গ্রামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা করেছেন যে, ‘মে মাসের ৩০ তারিখ এর শেষ রাতের দিকে আমরা ভয়ংকর হট্টগোল শুনতে পেয়েছিলাম এবং ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেছিলাম কিন্তু পালিয়ে যারার আগে সশস্ত্র সেনাবাহিনীর একটি দল আমাদের গ্রামে এসেছিল এবং বাতাসে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের নড়াচড়া করতে মানা করেছিল। এরপর কি হয়েছিল তা মনে করাটা যথেষ্ট ভয়ংকর, কারণ আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম সেনাবাহিনী ঘরবাড়ির উপর এবং যেসব মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে পালাতে শুরু করেছিল তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করল। আমার মনে হয়েছিল যে, সব শেষ হয়ে গেল। আমি দেখলাম অধিকাংশ মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সবাই বলছিল যে, যারা মারা গিয়েছে তাদের মাঝে সাধনা মোহন এবং অক্ষয় ছিল।’

সুগুরিপাতা গ্রামে ২৫ জন মৃত মানুষের মধ্যে ১৭জন নারী এবং শিশু ছিল। শিশুদের সবাই ছিল পনের বছর বয়সের নিচে। সুগুরিপাতা গ্রামের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জুম্ম বর্ণনা করেছেন যে, ‘সৈন্যরা গ্রামের অধিকাংশ নারীর স্পর্শকাতর অংশগুলোতে গুলি, বেয়নেট দিয়ে আঘাত করেছিল এবং তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়েছিল। গ্রামের অনেক মানুষকে তাদের ঘরের সাথে বেঁধে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমার বন্ধু সনৎকে অনেক আঘাত করেছিল এবং তাকে বারবার শান্তিবাহিনরীর খবর জিজ্ঞাসা করছিল। যখন যে বলেছিল যে সে কিছু জানে না তখনই আরেকজন জুম্মকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। গ্রামে অধিকাংশ মহিলা ছিল ধর্ষিত এবং আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে, আমরা কী করে বেঁচে গেলাম। আমি জানিনা কতজন মারা গিয়েছে, তবে আমি ৩০ থেকে ৪০টি মৃতদেহ দেখেছিলাম যাদের মাঝে দশজন ছিল ছোট শিশু। অধিকাংশ শিশুকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছিল।’

সুগুরিপাতা গ্রামের মৃতদের মাঝে ছিলেন সনৎ কুমার চাকমা এবং তার ছেলে ভগবান চন্দ্র চাকমা যাদের দু’জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছিল।

১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক জুম্মদের উপর কমপক্ষে ১৩টি গণহত্যা চালানো হয়। বাংলাদেশ সরকার এই গণহত্যাগুলোর একটিরও বিচার এখনও পর্যন্ত করেনি।

More From Author