বিগত এক বছরে সংখ্যালঘুর উপর ৪৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে: ঐক্য পরিষদ

হিল ভয়েস, ৮ জুলাই ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: বাংলাদেশ হিন্দু বেদ্ধৈ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ ২০২৩ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। এসময়কালে সংখ্যালঘুর ৪৫ জন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে ঐক্য পরিষদ। ঢাকাস্থ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সোমবার (৮ জুলাই) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত রিপোর্ট পাঠ করে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত।

উক্ত রিপোর্টে বলা হয় যে, এ সময়কালে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি, মরদেহ উদ্ধার (হত্যাকান্ড বলে প্রতীয়মান) হয়েছে ৭ জনের, হত্যার চেষ্টা হয়েছে ১০ জনকে, হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ৩৬ জনকে, হামলা/ শারীরিক নির্যাতন/ জখম হয়েছে ৪৭৯ জন, চাঁদা দাবি করা হয়েছে ১১ জনের কাছ থেকে, বসতঘর/ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা/ ভাংচুর/ লুটপাট/ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১০২টি, বসতবাড়ি/জমিজমা দখলের ঘটনা ঘটেছে ৪৭টি, বসতবাড়ি/জমিজমা দখলের/উচ্ছেদের তৎপরতা ও হুমকির ঘটনা ঘটেছে ৪৫টি, দেশত্যাগের হুমকি/ বাধ্য করার চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১১টি, দেবোত্তর/মন্দির/গীর্জার সম্পত্তি দখল ও দখলের চেষ্টার ঘটনা হয়েছে ১৫টি, শ্মশানভূমি দখল/দখলের চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৭টি, মন্দিরে হামলা/ ভাংচুর/ লুটপাট/ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৯৪টি, প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে ৪০টি, গণধর্ষণ/ধর্ষণ/ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৫টি, অপহরণ/নিখোঁজ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে ১২টি, ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগে আটক হয়েছে ৮ জন, জাতীয় নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে ৩২টি, স্থানীয় নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে ৫টি, অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে ১৪টি, মোট ঘটনা ঘটেছে ১,০৪৫টি।

ঐক্য পরিষদের মতে, এ সংখ্যাটি সাম্প্রদায়িক চালচিত্রের একটি আংশিক অংশমাত্র। বিগত বছরগুলোর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সহিংসতার ঘটনার খুব বেশী হেরফের আজও হয়নি। এহেন বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে লক্ষনীয়, ১৯৭০ এর নির্বাচনকালীন সময়ের প্রায় ১৯% সংখ্যালঘু ৮.৬%-এ নেমে এসেছে।

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের চালচিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশেষ করে সংখ্যালঘু স্বর্ণব্যবসায়ী ও তাদের পরিবার, মন্দির ও উপাসনালয় এবং বিগ্রহ, সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি ও স্কুল কলেছে পড়–য়া অপ্রাপ্তবয়ষ্ক মেয়েরা সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার পরিবেশ একেবারেই সংকুচিত করা হয়েছে। পুলিশ প্রহরায় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলাকালে সন্ত্রাসীদের কাউকে জনগণ আটক করলে পুলিশ প্রশাসন তাকে ‘পাগল’ বানিয়ে মূলত সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকেই উৎসাহিত করে।

ফেইসবুক হ্যাক করে ধর্ম অবমাননার কল্পিত অভিযোগে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ীকে আক্রমণের শিকার করছে, অহেতুক যুবক সম্প্রদায়কে হয়রানী করছে। সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ৭০ থেকে ৭৫% ভূমিকেন্দ্রিক।

ভূমি জবরদখলের বদমতলবে ভূমিখেকো সন্ত্রাসীরা প্রায় বেশীরভাগ সময় নানান রাজনৈতিক দলের প্রভাবপুষ্ট হয়ে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এ সাম্প্রদায়িক সহিংস আক্রমণ পরিচালনা করছে। সিটি কর্পোরেশনের মতো সরকারী সংস্থাও জমি জবরদখলের ঘৃণ্য কাজে জড়িত। ঢাকায় অতিসাম্প্রতিককালে বংশালের আগাসাদেক লেনের মিরনজিল্লা হরিজন পল্লী, যাত্রাবাড়ীর ধলপুরের তেলেগু কলোনী এবং কমলাপুর রেল লাইনের পাশের হরিজন পল্লীর বাসিন্দাদের পুণর্বাসনের কোন ব্যবস্থা না করে তাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের অপপ্রয়াসের দুঃখজনক অমানবিক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

চলতি বছরের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতাদের ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অপপ্রয়াসও দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা গেছে। শুধু তাই নয়, এ দু’টি নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তারা মূলত সরকারী দলের। কেউ দলীয় প্রতীকে, কেউবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। লক্ষ্য করা গেছে ব্যতিক্রমবাদে প্রার্থীদের অনেকে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোটদানে নানানভাবে শুধু বিঘœই সৃষ্টি করেনি, প্রকারান্তরে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এ বিভাজনের কারণে নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষের হাতে সংখ্যালঘু জনাগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নির্বাচনে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেছে।

এহেন পরিস্থিতিতে ঐক্য পরিষদের দাবিকে যথাযথ বিবেচনায় এনে সরকারী দল আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশকিছু সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধন অঙ্গীকার করে। যদিও এ অঙ্গীকারসমূহের বেশীরভাগই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও সরকারী দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তার কোনটিই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারসমূহের মধ্যে রয়েছে- (ক) সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ব আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণের’ ধারা সুরক্ষার উদ্যোগ অব্যাহতকরণ; (খ) অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রয়োগের বাধা দুরীকরণ; (গ) জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়ন; (ঘ) বিএনপি-জামাত জোট সরকারের ‘এথনিক ক্লিনজিং’ অপনীতির কবলে যে সব অমানবিক ঘটনা ঘটেছে তার বিচারকার্য সম্পন্নকরণ এবং তার পুণরাবৃত্তি রোধকরণ; (ঙ) ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও চা বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, জীবন সম্পদ সম্ভ্রম মান-মর্যাদা সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিতকরণের নীতি অব্যাহতকরণ; (চ) দেশের সকল অনগ্রসর অঞ্চলের সুষম উন্নয়ন এবং ঐ সব অঞ্চলের জনগণের জীবনের মানোন্নয়নে অগ্রাধিকার প্রদান।

আজকের এ সংবাদ সম্মেলন থেকে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গীকারসমূহ পূরণে সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হয়েছে।

More From Author

+ There are no comments

Add yours