বাঘাইছড়িতে তিন সংগঠনের উদ্যোগে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২৫, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি থানা কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি থানা শাখা ও মহিলা সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির যৌথ উদ্যোগে সাবেক হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৯ বছর উপলক্ষে ‘জুম্ম নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত কল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করা, অপহরণ ঘটনায় অভিযুক্ত লেঃ ফেরদৌস, মোঃ সালেহ ও মোঃ নুরুল হক এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে’ এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ ১২ই জুন, সকাল ১০:৩০ ঘটিকার সময়ে বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩০ নং সারোয়াতুলি ইউনিয়নের শিজক কলেজের মিলনায়তনে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বাঘাইছড়ি থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক উদ্দীপন চাকমার সঞ্চালনায় এবং মহিলা সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি মিসেস লক্ষীমালা চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি পুলকজ্যোতি চাকমা। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেএসএস বাঘাইছড়ি থানা আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য সচিব নয়নজ্যোতি চাকমা, মহিলা সমিতির বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সদস্য মিসেস সমাপ্তি দেওয়ান, বাঘাইছড়ি থানা যুব সমিতির তথ্য ও প্রচার বিষয়ক সম্পাদক নিহার বিন্দু চাকমা এবং ৩০ নং সারোয়াতুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভূপতিরঞ্জন চাকমা।

আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলকজ্যোতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে জুম্ম নারীর উপর সহিংসতার অন্যতম ন্যাক্কারজনক, কাপুরুষোচিত ও ঘৃণ্য উদাহরণ হচ্ছে বাঘাইছড়ি উপজেলার ৩২ নং বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের নিউ লাল্যেঘোনা গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে রাতের আঁধারে তৎকালীন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ ও দীর্ঘ ২৯ বৎসরেও তার খোঁজ দিতে না পাড়া এবং অপহরণ ঘটনায় চিহ্নিত অপরাধী লেঃ ফেরদৌস গংদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়া।

তিনি বলেন, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর উদ্বেগের কিছুই হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করার মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের নারী নেতৃত্বকে এবং নারীদের সাহসী কন্ঠস্বরকে চিরঘুমের দেশে পাঠানো গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজ পাহাড়ে হাজারো কল্পনার যোগ্য উত্তরসূরী সৃষ্টি হয়েছে। কল্পনার এই উত্তরসূরীরা অপহৃত কল্পনার চেয়েও অধিক গুণে গুণান্বিত হয়ে, প্রতিবাদী হয়ে পাহাড় সহ পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত-নির্যাতিত গণমানুষের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাঘাইছড়ি থানা যুব সমিতির নিহার বিন্দু চাকমা বলেন, সংখ্যাতে এবং সবদিক দিয়ে যারা ছোট জাতি তাদের একটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর প্রতি অনেক আশা-প্রত্যাশা থাকে।এবং কিছু ক্ষেতে নির্ভরশীলতাও থাকে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে সেরকমের কোনো আশ্রয় খুঁজে পায় না। বরঞ্চ দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন-বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আজ আমাদের জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তপ্রায়।

তিনি আরও বলেন, আমরা কোনো অবস্থাতেই আমাদের জাতীয় অস্তিত্বকে চোখের সামনে এভাবে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। আমাদের জুম্ম তরুণ-যুবদের অতি অবশ্যই সেই সত্তর-আশি দশকের ন্যায় আবারও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার-কঠিন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বৃহত্তর আন্দোলনে অধিকতরভাবে সামিল হতে হবে।

বিশেষ অতিথি ৩০ নং সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভুপতি রঞ্জন চাকমা তাঁর যুবক বয়সের অতীত স্মরণ করে বলেন, আমরা তখন সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়ে যুবকে পদার্পণ করেছিলাম। সেইসময়ে বাঘাইছড়িতে পার্টির বিভিন্ন প্রোগ্রাম হতো, আমরা পার্টির সেই প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণ করতাম। সেখানে কল্পনা চাকমাও থাকতেন, তিনি খুব ভালো বক্তৃতা দিতেন এবং আমরা খুব মন দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনতাম এবং বুঝতে চেষ্টা করতাম। কল্পনা চাকমা খুব ভালো সংগঠক ছিলেন। তাঁর কথাবার্তা এবং বক্তব্য দিয়ে তিনি খুব সহজে নারীদের সংগঠিত করতে পারতেন।

তিনি আরও বলেন, তৎকালীন সময়ে কল্পনা চাকমা অপহৃত হওয়ার পরপরই আমরা বাঘাইছড়িতে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করি। এতে আরও সমর বিজয়-সুকেশ-মনতোষ-রুপমকে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলি।

স্বাগত বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিউলি চাকমা বলেন, রাষ্ট্রকে অবশ্যই কল্পনা চাকমা অপহরণে জড়িত লেঃ ফেরদৌস, মোঃ সালেহ আহমেদ এবং মোঃ নুরুল হকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বহিরাগত সেটেলার ও শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পাহাড়ে নারী নিপীড়ন, অপহরণ, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার সকল ঘটনার জবাবদিহি করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যের শেষে আলোচনা সভাটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।

More From Author