বরকলে জুম্মদের কৃষিপণ্য পরিবহন ও বিক্রয়ে সেটেলারদের চাঁদাবাজি ও অবৈধ সিন্ডিকেট

0
1794

হিল ভয়েস, ২৮ জুলাই ২০২০, রাঙ্গামাটি:  সম্প্রতি কোভিড-১৯ মহামারীর দুর্যোগের মধ্যেই রাঙ্গামাটি জেলাধীন বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের ছোট হরিণা বাজারে বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য বিক্রেতা জুম্মদের কাছ থেকে একটি সেটেলার বাঙালি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় বিজিবির ছত্রছায়ায় ও মদদে জুম্মদের কৃষিপণ্য পরিবহন ও বিক্রয়ের উপর সেটেলাররা প্রকাশ্যে এ ধরনের চাঁদাবাজি ও জবরদস্তিমূলক নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

এমনকি কৃষি নির্ভর গরীব জুম্মরা একটু লাভের আশায় নিজেদের বা জুম্মদের বোটে কোন কৃষি পণ্য রাঙ্গামাটি জেলা সদর বা সুবলং বাজারে নিয়ে যেতে চাইলে তাতেও বাধা সৃষ্টি করছে এই সেটেলার বাঙালি সিন্ডিকেট। কৃষিপণ্য নিয়ে রাঙ্গামাটি সদর বা সুবলং বাজারে গেলে জুম্মদের কোন বোট নয়, বরং বাঙালিদের নির্ধারিত বোটে ভাড়া দিয়েই যেতে হবে বলে নিয়ম বেঁধে দেয় এই সিন্ডিকেট।

গতকাল ২৭ জুলাই ২০২০ পর্যন্তও যেসব জুম্ম কৃষিপণ্য নিয়ে ছোট হরিণা বাজারে এসেছেন, তারাও তাদের পণ্যের বিপরীতে এই অবৈধ চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানা গেছে। নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক জুম্ম জানান, প্রায় দুই মাস ধরে জুম্ম কৃষিপণ্য বিক্রেতাদের কাছ থেকে এভাবে টাকা নেয়া এবং রাঙ্গামাটি ও সুবলং বাজারে গেলে বাঙালিদের বোট নিয়ে যেতে বাধ্য করার নামে হয়রানি ও শোষণ করা হচ্ছে।

ছোট হরিণা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির দোহাই দিয়ে এবং স্থানীয় বিজিবি জোনের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সেটেলার বাঙালি সাইফুল ইসলাম মনির এর পক্ষে লেবার সর্দার মো: সেলিমসহ কতিপয় সদস্য এই অন্যায়, বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বলাবাহুল্য, এই অবৈধ কাজ চলছে বিজিবি জোনের চেকপোস্টের সামনে, জনসমক্ষে এবং অন্তত দুই মাস ধরে। কিন্তু প্রশাসন দেখেও না দেখার, জেনেও না জানার ভান করছে এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

তবে ছোট হরিণা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: আব্দুল মান্নান ও বিজিবি’র ১২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের ছোট হরিণা জোন-এর জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল মোহাম্মদ ইমরুজ্জামান সাইফ কৃষিপণ্যের জন্য জুম্মদের কাছ থেকে টাকা নেয়া এবং বাঙালিদের বোট ভাড়া করতে বাধ্য করার বিষয়ে জানেন না বলে জানান। জোন কম্যান্ডার এ ব্যাপারে খবর নেবেন এবং কেউ এরকম করে থাকলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান।

ছোট হরিণা বিজিবি জোন কমান্ডার বিষয়টি জানেন না বললেও স্থানীয় জুম্ম কৃষকদের অভিযোগ, সেটেলাররা বিজিবির মদদে ও আশ্রয়ে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বিজিবির অজ্ঞাতসারে কিংবা অমতে সেটেলারদের পক্ষে প্রকাশ্যে এধরনের কাজ করার সাহস করতো বলে তারা অভিযোগ করেন। জুম্ম কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি করতেই বিজিবির মদদে সেটেলাররা এধরনের অপকর্ম চালাচ্ছে বলে ভুক্তভোগী জুম্মরা জানান।

জানা গেছে, গতকালও দীর্ঘ দিনের ভুক্তভোগী তেমিয় কুমার চাকমা কৃষি পণ্যের উপর এই টাকা নেয়া ও বাঙালিদের বোট ভাড়া করতে বাধ্য করার ব্যাপারটি বিরোধীতা করায় লেবার সর্দার মো: সেলিম ক্ষেপে গিয়ে তেমিয় কুমারকে গালিগালাজ করেন এবং আক্রমণ করার চেষ্টা করেন।

এরপর থেকে বিভিন্ন অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। মানুষ কৃষিপণ্যের জন্য জুম্মদের কাছ থেকে টাকা নেয়া এবং বাঙালিদের বোট ভাড়া করতে বাধ্য করার ব্যাপারটি অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেন।

এক পর্যায়ে আজ (২৮ জুলাই ২০২০) সকালের দিকে ছোট হরিণা বাজারে ছোট হরিণা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: আব্দুল মান্নানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কমল জ্যোতি চাকমা, স্থানীয় সমাজ সেবক বরুণ চাকমা, ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম মনির, ছোট হরিণা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির অন্যান্য সদস্য ও ভুক্তভোগী তেমিয় কুমার চাকমা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ ‘অভিযোগ সত্য’ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ী সমিতি এসব অপকর্মের বিষয়ে অবগত ছিলেন না বলে জানান।

সভায় সিদ্ধান্তক্রমে লেবার সর্দার মো: সেলিম ‘কোনদিন এমন অপকর্ম করবে না’ মর্মে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন। সভায় ইতিপূর্বে “(১) জুম্মদের বোট মালামাল নিয়ে হরিণা বাজার ঘাটের পর আর নেয়া যাবে না, বাঙালিদের বোট নিয়ে যেতে হবে, (২) বাজারে জুম্মরা নিজের মালামাল বিক্রির জন্য আনলোড করতে পারবে না, নিজে করলেও বাঙালি শ্রমিকদের টাকা দিতে হবে এবং (৩) মালামাল ভর্তি বোট প্রতি ৪০০ টাকা দিতে হয়”-ইত্যাদি যে নিয়ম ছিল, সেগুলো আর চাপিয়ে দেয়া হবে না বলেও অঙ্গীকার প্রদান করা হয়।

ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: আব্দুল মান্নান ভুক্তভোগী গ্রামবাসী ও মুরুব্বিদের আশ্বস্ত করে বলেন, জুম্মদের কেউ বাধা দিলে বা চাঁদা দাবি করলে আমাদের জানালে আমরা ব্যবস্থা নেব এবং এমন অপ্রীতিকর ঘটনা আর পুনরাবৃত্তি হবে না।

অপরদিকে, প্রাক্তন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কমল জ্যোতি চাকমা বলেন, আমরা ছোট হরিণা বাজারে পাহাড়ি (জুম্ম)-বাঙালি অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছি, কিন্তু আমাদের অজ্ঞাতে কিছু লোক নিরীহ কৃষকদের কৃষি পণ্য পরিবহণে ইঞ্জিন চালিত বোট পাল্টাতে বাধ্য করা, চাঁদা দাবি করা ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়েছে। আজ আমরা একসাথে বসে সুরাহা করেছি। এখন থেকে যার যার ইঞ্জিন চালিত বোট নিয়ে কৃষকেরা তাদের কৃষিপণ্য নিয়ে তাদের ইচ্ছা মত বাজারে যেতে পারবে। কেউ বাধা দিলে আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

ভুক্তভোগী তেমিয় কুমার চাকমাও সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান। অন্যান্য গ্রামবাসীরাও সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানান। তবে, বাস্তবে সেটা কতটুকু কার্যকর হয়, সেটা পর্যবেক্ষণ করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন, জনৈক গ্রামবাসী।

উল্লেখ্য, ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী ও রাঙ্গামাটির প্রত্যন্ত এলাকা ভূষণছড়া ও বড় হরিণা ইউনিয়নে বসবাসকারী কৃষিজীবী জুম্মদের প্রধান পেশা হচ্ছে বিভিন্ন ফলমূল, মসলা জাতীয় ফসল ও শাকশবজি চাষাবাদ। আর তাদের নিকটতম একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বাজার হচ্ছে এই ছোট হরিণা বাজার। এই বাজারে তাদের উৎপাদিত ও সংগৃহীত ফসল ও শাকশবজি বিক্রি করেই তারা কিছু টাকা উপার্জন করেন। অনেক সময় সীমান্তবর্তী ও একমাত্র বাজার হওয়ার কারণে তারা অনেক পণ্যদ্রব্যের ন্যায্য মূল্য পান না। সে কারণে বাধ্য হয়ে নিজেদের বোটে অথবা ভাড়া করা বোটে তারা সেই পণ্যদ্রব্য সুদূর সুবলং বাজার ও রাঙ্গামাটি সদরে নিয়ে যান।

কিন্তু ইতোমধ্যে সেটেলার বাঙালিদের উক্ত সিন্ডিকেটটি জুম্ম কাঁচামাল বিক্রেতাদের নানাবিধ চাঁদা দিতে এবং জোরজবরদস্তিমূলকভাবে বাঙালিদের বোট ভাড়া নিতে বাধ্য করায় জুম্মরা হয়রানি ও শোষণের শিকার হচ্ছিলেন অনেকদিন ধরে।