হিল ভয়েস, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: “সকল প্রকার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হোন” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৯তম শাখা সম্মেলন ও কাউন্সিল ২০২৫ রোজ শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাঙ্গামাটি সদরস্থ উদ্যোগ রিসোর্স সেন্টার হল রুমে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সম্মেলন ও কাউন্সিল উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ- ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা, পিসিপি কেন্দ্রীয় সভাপতি রুমেন চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এলি চাকমা ও পিসিপি রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা প্রমুখ।
এছাড়াও সম্মেলন ও কাউন্সিলে জনসংহতি সমিতি, মহিলা সমিতি, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পিসিপির বিভিন্ন শাখার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সম্মেলন ও কাউন্সিলে জুয়েল চাকমা বলেন, “পঁচাত্তরের পর সারা দেশে সামরিক শাসন জারি হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তখন মহান পার্টি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর বাংলাদেশ সরকারের সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে ওঠে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের পর অনেক ত্যাগ তিতীক্ষার বিনিময়ে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু সেই চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বিগত কোন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়নি। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মারামারি,হানাহানি,ধর্ষণের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক বিশেষ গোষ্ঠীর সহায়তায় ভূমি কমিশনের মিটিং হওয়ার সিদ্ধান্ত হলে বাঁধা প্রদান করা হয়। তাই আমাদের এসব বিষয় উপলব্ধি করে জুম্ম জাতীয় মুক্তির আন্দোলন সংগ্রামে শামিল হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যুগে যুগে ইতিহাসে যখনই কোনো অন্যায়, অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে ছাত্র সমাজ তার প্রতিবাদ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র লড়াকু ছাত্র সংগঠন পিসিপি। পিসিপির প্রত্যেক কর্মীর ত্যাগ করার মানসিকতা থাকতে হবে। তাই পিসিপির প্রত্যেক কর্মীকে অধ্যয়ন করে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে আরো দক্ষ হয়ে উঠতে হবে।
রুমেন চাকমা বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্ব ও বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতা এক তাল-মাতাল অবস্থায় রয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বহু যুদ্ধ চলমান রয়েছে। বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় এশিয়া অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। আমদের দেশ যেহেতু বিশ্ব বাস্তবতার বাইরে নয় সেহেতু এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও আমাদের মতো অধিকারহীন জাতিসমূহের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তার উপর বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব এক গভীর ও অনিশ্চিত সংকটে ফেলেছে।
তিনি আরো বলেন, পিসিপি যেহেতু সমগ্র জুম্ম ছাত্র সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে তাই তাদের উপর-ই দায়দায়িত্ব বেশি বর্তায়। পিসিপি কর্মীদেরকে অবশ্যই প্রগতিশীল আদর্শের ভিত্তিতে নেতৃত্বের জায়গায় গড়ে উঠতে হবে। জুম্ম জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করার জন্য রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত সংগ্রামকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক কর্মীকে অবশ্যই ব্যাপক অধ্যয়ন, গভীর অনুশীলন এবং এর সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। পিসিপি কর্মীদের সবসময় নীতি ও আদর্শের আলোকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
এলি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের ওপর প্রতিনিয়ত শোষণ-নির্যাতন চলমান। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে নিরব ইসলামিকরণ চলছে। জুম্ম জাতির অস্তিত্ব এখন তাই বিলুপ্তির পথে। এসব শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পেতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথভাবে বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ছাত্র সমাজকে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন সংগ্রামে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
সুনীতি বিকাশ চাকমা বলেন, যুগে যুগে পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণ বিজাতীয় শাসন শোষণের শিকার হয়েছে𑅁 বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ অঞ্চলের জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখনো পর্যন্ত চুক্তির মৌলিক ধারা গুলো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে। চুক্তির পূর্ববর্তী “অপারেশন দাবানল” এবং চুক্তি পরবর্তী অপারেশন “অপারেশন উত্তরণ” নামে এখনো সেনাশাসন অব্যাহত রয়েছে। চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্মোদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি,কৃষ্টি এককথায় জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম ছাত্র সমাজকে এ বিষয়ে সচেতন হয়ে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার বিদায়ী কমিটির সভাপতি সজল চাকমার সভাপতিত্বে এবং বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক জ্ঞান চাকমার সঞ্চালনায় সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ইমন চাকমা এবং সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক করুন জ্যোতি চাকমা।
সম্মেলন অধিবেশন শেষে জ্ঞান চাকমাকে সভাপতি ও বিশ্বজিত চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক ও নিহির চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পিসিপি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার ২৯তম কমিটি প্রস্তাবিত কমিটি নির্বাচিত করা হয়।
নব নির্বাচিত কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান পিসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য ম্যাগলিন চাকমা।