হিল ভয়েস, ২০ জুন ২০২৫, রাঙ্গামাটি: “সকল প্রকার বিভেদ প্রতিহত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলনে জুম্ম ছাত্র সমাজ অধিকতর সামিল হউন” আহ্বানে আজ ২০ জুন ২০২৫ রাঙ্গামাটি সদরে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর রাজদ্বীপ আঞ্চলিক শাখার ৫ম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি রাঙ্গামাটি শহর কমিটির সভাপতি দেবমোহন চাকমা, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজদ্বীপ এলাকার কার্বারী ভাগ্যচন্দ্র চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সুনীতি বিকাশ চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কাঞ্চনমালা চাকমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাঙ্গামাটি শহর শাখার সভাপতি সুরেশ চাকমা।
আলোচনা সভার শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আত্মবলিদানকারী বীরদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দেব মোহন চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত সমস্যাটি কী, সেটি আগে ছাত্রসমাজকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কয়েক কিলোমিটার পর পর সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট রয়েছে। এটি কি প্রমাণ করে না যে এখানে এক ধরনের অঘোষিত সেনাশাসন চলছে? যদি ছাত্রসমাজ এসব বিষয় উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে সামনে আমাদের জন্য বড় ধরনের সংকট অপেক্ষা করছে।
তিনি বলেন, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। অঞ্চলটি যেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, এসব সংগঠনের অনেকেই এখন রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এক ধরনের রাজনীতি বিমুখতা তৈরি হয়েছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অধিক যে রাজনৈতিক সংকট, তার সমাধান শুধুমাত্র সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে সম্ভব নয়। এই সংকটের রাজনৈতিক চরিত্রকে না বুঝে এবং তার যথাযথ রাজনৈতিক সমাধানের পথ অনুসরণ না করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে অনেক ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী বাস করলেও অনেক জাতি আজ রাজনৈতিকভাবে সচেতন না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা যদি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে সংগ্রাম করতে না পারি তবে আমরা ও হারিয়ে যাবো।
তিনি বলেন, আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। বর্তমান প্রজন্মকে এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে এবং ছাত্রসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কার্বারী ভাগ্যচন্দ্র চাকমা বলেন, মহান পার্টি জনসংহতি সমিতি জুম্মদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম কাঁধে না নিলে বর্তমানে তাদের অস্তিত্ব আমরা দেখতে পেতাম না। একই দায়িত্বভার বর্তমান ছাত্র যুব সমাজকে কাঁধে নিতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুনীতি বিকাশ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠা তথা মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে মহান পার্টি জনসংহতি সমিতির জন্মলাভ হয়েছিল। দীর্ঘ দেড় যুগের বেশি ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়েই অর্জিত হয় জুম্মদের মুক্তির দলিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা এবং সেনাশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নই হতে পারে এ প্রধান দুটি সমস্যার অন্যতম উপায়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কাঞ্চনমালা চাকমা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেশের সমতল অঞ্চলে বাস্তবায়িত হলেও আদিবাসী তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জুম্মদের বেলায় তা আমরা দেখতে পাই না। এই অঞ্চলে শুধুমাত্র শাসকের পতন হয়েছে কিন্তু শাসনকাঠামো ঠিক আগের মতোই রয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুরেশ চাকমা বলেন, বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ষাটের দশকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গড়ে উঠে প্রতিবাদী আন্দোলন। তাঁর নেতৃত্ব জুম্ম জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে সত্তরের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাঁকে এই অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার এই সংগ্রাম বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে বুকে ধারণ করে আন্দোলন আরো বেগবান করতে হবে।
পিসিপির রাজদ্বীপ আঞ্চলিক শাখার বিদায়ী কমিটির তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আর্য্য চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত কাউন্সিলে বিদায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতনময় চাকমার সভাপতিত্ব করেন এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন পিসিপি রাজদ্বীপ আঞ্চলিক শাখার বিদায়ী অর্থ সম্পাদক প্রফিট চাকমা।
কাউন্সিলে রতনময় চাকমাকে সভাপতি, নেপোলিয়ন চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক এবং আর্য্য চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট রাজদ্বীপ আঞ্চলিক শাখা কমিটি গঠন করা হয়।
নবগঠিত কমিটিকে শপথবাক্য পাঠ করান পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, রাঙ্গামাটি জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক মামুনি চাকমা।
+ There are no comments
Add yours