হিল ভয়েস, ২৪ অক্টোবর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: পাবর্ত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বরকল থানা শাখার উদ্যোগে আজ ২৪ অক্টোবর ২০২৫ প্রথমবারের মতো বরকল রাগীব রাবেয়া কলেজে ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের “নবীন বরণ ও কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা” অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য বিধান চাকমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য শ্যাম রতন চাকমা, কার্বারী এসোসিয়েশন বরকল থানা কমিটির সভাপতি নন্দ বিকাশ চাকমা, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির অর্থ সম্পাদক ছাত্রনেতা রনেল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ম্রানুসিং মারমা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিবেক চাকমাসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

এই সময় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বরকল থানা শাখার সহ-সভাপতি পলু মারমা ও নবীনদের উদ্দেশ্যে অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী হ্যাপি চাকমা। অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয় এবং কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা স্মারক প্রদান করা হয়।
প্রধান অতিথি বক্তব্যে বিধান চাকমা বলেন, পাহাড়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের সমাজের সচেতন অংশ। তাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে তাদের ভূমিকা জোরালোভাবে থাকা উচিত। বিদ্যা গ্রহণ শুধু চাকরির উদ্দেশ্যে নয়, বরং জ্ঞান অর্জন করে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য লেখাপড়া করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান পরিস্থিতি জুম্ম জনগণকে প্রান্তিক ও নিশ্চিহ্নতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের অধিকার আদায় করতে হলে শিক্ষিত হতে হবে, ত্যাগী হতে হবে। ত্যাগই মানুষের জীবনকে মহান করে তোলে। আজকের ছাত্রসমাজ ত্যাগ ও শিক্ষায় এগিয়ে আসবে, জুম্ম জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কান্ডারী হবে সেই প্রত্যাশা।
শ্যাম রতন
চাকমা বলেন, বরকল উপজেলা শিক্ষার দিক দিয়ে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। বরকল তথা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার বাস্তবতাকে রাষ্ট্রযন্ত্র জুম্মদের প্রতিকূল করে রেখেছে। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে শুধু বাঙালিরা ছিলেন না আদিবাসী শিক্ষার্থী ও প্রগতিশীল মানুষদের ভূমিকাও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র সেসব অস্বীকার করে মূল্যায়ন করছে না। কাজেই এই রাষ্ট্র থেকে কিছু আশা করা যায় না। নিজের জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
নন্দ বিকাশ চাকমা বলেন, আমরা এই দেশের নির্যাতিত নিপীড়িত এক জাতি। এই দেশের সরকার আমাদের অধিকার দিতে অনিচ্ছুক। তাই নবীন শিক্ষার্থীদের উচিত আগামী দিনে আমাদের অবস্থান কি হবে চিন্তা ভাবনা করা। শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি সমগ্ৰ বিশ্ব সম্পর্কে জানতে হবে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে সরকার ও সেটেলার কর্তৃক যে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছি সেখান থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি জানাতে হবে।
রনেল চাকমা বলেন, শিক্ষা শুধু মুখস্থ করে বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। শিক্ষার আসল মাহাত্ম্য যখন সেই শিক্ষা আমাদের পরিবার, সমাজ ও জাতির জন্য সুনাম বয়ে আনে। আমাদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি পাবর্ত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস জানতে হবে, নিজ নিজ জাতির অতীত জানতে হবে। আমাদের শিক্ষা অর্জন হতে হবে আধুনিক বিশ্বের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারার মতো। তিনি আরও বলেন, আমাদের জানশোনা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশের মধ্যে যেন সীমাবদ্ধ না থাকে। শেকড়কে আঁকড়ে ধরে শিক্ষা অর্জন করে আমাদের বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে যেতে হবে।
ম্রানুসিং মারমা বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থী একটি লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে পড়তে আসে। সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিজেকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগোতে হবে। বাবা-মা, পরিবার, সমাজ তথা জাতির জন্য কাজ করার মানসিকতা নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজ নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করে অধিকার সম্পর্কে, আমাদের ওপর হওয়া শোষণ-নিপীড়ন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের নিজেদের কাছে প্রশ্ন করতে হবে। রাজনৈতিক-সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ বিনির্মানে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

রিবেক চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক পরিবেশকে মোকাবিলা করে মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পা দেওয়া নিশ্চয়ই একটা অর্জন। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জ্ঞান ও দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ ও শেকড়কে বুকে ধারণ করে আজকের নবীনদেরকেই আগামী দিনের পাহাড়ে আলো জ্বালতে হবে। তিনি বলেন, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি মানবিক গুণাবলী তথা জ্ঞান, দক্ষতা, সচেতনতা ও নৈতিকতা অর্জনের প্রক্রিয়াটাই হলো শিক্ষা এবং সেই শিক্ষাটা হতে হবে ব্যক্তির মানবিক উৎকর্ষতা ও পরিবার-সমাজ-জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। যুগে যুগে ছাত্র ও তরুণরাই সমাজকে পথ দেখিয়েছে, জাতির দুর্দিনে হাল ধরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক বাস্তবতায় জুম্ম ছাত্রসমাজকেও ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
পাবর্ত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বরকল থানা শাখার সাধারণ সম্পাদক নিশান তালুকদার ও সহ-সাধারণ সম্পাদক জিতেশ চাকমার যৌথ সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের বরকল থানা শাখার সভাপতি ইলেন চাকমা।