পাহাড়ে অন্যায় যুদ্ধের দামামা ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

0
1014

সুহৃদ চাকমা

একটু আধটু লিখি সেকথা যারা জানেন তারা হয়তো বলবেন যে, যুদ্ধ নিয়ে লিখুন যত খুশি, তবে নিজের মাথা বিক্রি করে নয়। অর্থাৎ বক্তব্য খুব পরিষ্কার। যুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে যাই লিখুন না কেন, সেটার পেছনে যেন নিজের ধান্দা না থাকে। ভাবনায় যেন প্রভাব না ফেলে অন্ধ রাজনৈতিক মতামত। সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির আন্দোলনের সপক্ষে আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়। আমি যখন লেখার চেষ্টা করছি তখন সাম্প্রতিক সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে ভূমিদস্যুদের কর্তৃক এছামং চাককে অপহরণ করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক দোছড়ি ইউনিয়নে সাধারণ জুম্মদের গ্রেপ্তার, মারধর, বাড়ি তল্লাশিসহ চাকদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র ও দেশে প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা না করে ৬ চাক গ্রামবাসীকে ৪ দিন পর্যন্ত ক্যাম্পে আটক রাখার বিষয়টা উত্থাপন না করলে লেখাটি অসমাপ্ত থেকে যাবে বলে আমার বদ্ধমূল ধারণা। এই নিরপরাধ ৬ জন গ্রামবাসীকে সেনা ও বিজিবি সদস্যরা গত ১লা সেপ্টেম্বর অমানুষিক মারধরের পর ক্যাম্পে নিয়ে অবৈধভাবে আটক করে রাখে যা মানবতার অপমৃত্যু ছাড়া অন্যকিছু নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই উপজেলায় ওয়াগ্গা ও জীবতলী ইউনিয়নে গত ৩০ ও ৩১ আগস্ট ২০২১ সংঘটিত সাধারণ জুম্মদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ এবং গুলি করে নির্দোষ জুমচাষীদের আহত, হত্যা, যত্রতত্র রাত-বিরেতে সেনাবাহিনীর অপারেশন, অভিযান সফলকাম হয়েছে তা প্রমাণের উদ্দেশ্যে সাধারণ জুম্মদের সন্ত্রাসী সাজিয়ে গ্রেফতার, অস্ত্র গুজিয়ে দিয়ে জায়েজ করা, মিথ্যা মামলা, হুমকি, শারীরিক ও মানসিক পীড়নই আমাকে পীড়িত করছে। বিশেষত আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে জনমনে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগ একটু আধটু মাথায় আসতে বাধ্য।

আমরা কোন পরিস্থিতির দিকে দাবিত হচ্ছি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ কী হবে? সোজাসাপ্টা কথায় বলে দিই, আমরা পাহাড়ের মানুষ যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে নয়, গোটা বিশ্বের দেশে দেশে যত হত্যা-জুলুম, অন্যায়-অবিচার ও সর্বপ্রকার অমানবিকতার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতেও আমরা দ্বিধাবোধ করি না। একটি ছোট্ট রাষ্ট্র ইসরায়েল কীভাবে দশকের পর দশক পুরো বিশ্বকে রক্তাক্ত করতে পারছে? আসলে ইসরায়েলের অস্তিত্ব ও গায়ের জোর তৈরি করেছে স্বয়ং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী বিশ্বব্যবস্থা। যদিও অস্বীকার এর নীতিতে চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর ভয়ংকর সংকটে দেশে দেশে তার প্রভূত্ব হারাচ্ছে বলে অনেকেরই অভিমত। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের উপর কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে চলে গেছে, তালেবানরা পুরো আফগানিস্তান দখলে নিয়ে তালেবান সরকার গঠন করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইরাক, লিবিয়ায় মার্কিনিদের গণহত্যা-ধ্বংসযজ্ঞে একদিকে ইসরাইল, অন্যদিকে সৌদি আরব ছিলো প্রধান সহযোগী। এখানে ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চয়ই প্রধান বিষয় নয়, মতাদর্শিক অবস্থানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এই অবিরাম লড়াই ইহুদি বনাম মুসলমানের নয়, লড়াই কেবলমাত্র মানুষ বনাম পুঁজির, দখলদার বনাম দখলকৃতের এবং শোষক বনাম শোষিতের লড়াই।

তবে যে কোন যুদ্ধ বাঁধলে তখন বোঝা যায় কত ধানে কত চাল। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে কতই না দুষ্কর! যুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক দেশে! কিন্তু সেটি কেবল ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এধরনের নিপীড়িত জাতি ও মানুষের মুক্তির লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস থেকে অনেক মুক্তিকামী মানুষ অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। এই অনুপ্রেরণার মূলে আছে নিপীড়িত ও শোষিত শ্রেণির মানুষ। সাম্প্রতিক পাহাড়ের চলমান পরিস্থিতিতে সমস্ত খবর তো আর সংবাদ মাধ্যমের রাজপথ হাঁটিয়ে শোষকের টেবিলে পৌঁছে দেওয়া যায় না। তাই উপযুক্ত গোপনীয়তা মাথায় রেখে তবেই রণকৌশল ঠিক করে এগিয়েছে নিপীড়িতরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতিতে গুজব এখন অনেক রকমই রটানো হবে, গোয়েবলসীয় অপপ্রচার ছড়ানো হবে। অর্থাৎ সোজা বাংলায় বলতে গেলে শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে বলবে সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আর যুদ্ধবাজ হিসেবেও তকমা লাগিয়ে দেবে। শাসকগোষ্ঠীর সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বলবে তথাকথিত শান্তির পূজারীরা। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ কোন সময়ে যুদ্ধের পক্ষে ছিল না। বরঞ্চ শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় যুদ্ধের জবাব দিতে জুম্ম জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রামে সামিল হতে বাধ্য হয়েছিল। তবে নিপীড়িত মানুষের লড়াই যারা করতে চায় তারাও ছাড়ার পাত্র নয়। যুদ্ধ বিষয়টা যেহেতু রাজনীতির, তাই যুদ্ধ সংক্রান্ত আলোচনা হলে অবশ্যই সেই নিরিখেই বিশ্লেষণ হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের শোষক বনাম শোষিত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে দেবে সেটাই স্বাভাবিক বিষয়। এই দ্বন্দ্ব হেতু এক পর্যায়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যেহেতু রাজনৈতিক এবং জাতীয় সমস্যা সেহেতু রাজনৈতিকভাবে যথাযথ সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে বিষয়টি সরলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ফলে দিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি জটিলতর হয়ে যাবে। একবিংশ শতাব্দীতেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগণ ভাল নেই। মোঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল পেরিয়ে অধুনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ ভাল অবস্থাতে নেই। এই ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জনগোষ্ঠীর উপর চলছে যুগ যুগ ধরে নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার স্টিমরোলার। নির্দয় সেনাশাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত ও শোষিত পাহাড়ের জুম্ম জনগণ। এখানেও একইভাবে শোষিত ও শোষকের লড়াই চলছে এবং ঔপনিবেশিক কায়দায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুগের পর যুগ ধরে শাসন-শোষণ করে চলেছে। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব আজ চরম সংকটে। এই সংকট থেকে যথাযথ উত্তরণের উপায় খুঁজে নিয়ে এক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময় শেখ হাসিনা নিজের মুখে বড় গলায় উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘পাহাড়ে আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।’ কিন্তু সরকার বা শাসকগোষ্ঠী যদি যুদ্ধের বিপক্ষে হন, তাহলে যুদ্ধের পক্ষে দামামা বাজাবে কেন??? কেন আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের চারিদিকে এক নৈরাজ্যকর অরাজকতা সৃষ্টি করছে শাসকশ্রেণি! পাহাড়ের চারিদিকে যেন যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে শাসকশ্রেণি, সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর এ কেমন বর্বরতা ও নৃশংসতার হোলিখেলা। অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীর অভিযানে নিরস্ত্র জুম্ম জনগণের উপর এই অমানবিক বর্বরতা সভ্য দেশের বিবেকবান মানুষ কখনো মেনে নিতে পারে না। সরকারের কথা আর কাজের তো কোন মিল নেই! আমরা অবশ্যই স্বীকার করি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করা এতোটাই সহজ ছিলো না, তারপরও সেই সময়ের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশে-বিদেশে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে বলে অনেকেরই অভিমত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন।

তবে শুধুমাত্র চুক্তি স্বাক্ষরের শুরুতে চুক্তি স্বাক্ষর করতে সাহস দেখালেন, দেশের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে উজ্জ্বল করেছেন এবং অনেক কিছু অর্জন হয়েছে ঠিক, কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা তো আজ বজায় থাকেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অর্জিত সবকিছু আজ নির্দয় সেনাশাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে, বরঞ্চ আজ দেশের ভাবমূর্তি বিদেশের মাটিতেও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে একটা সংস্কৃতি, একটা সভ্যতা, একটা জনগোষ্ঠী ও তার যাবতীয় জীবনধারাকে চিরতরে বিলুপ্তির জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে সরকার, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এধরনের অমানবিক কাজের জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত। আমরা এও জানি যে, আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় আসা যায় না পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই। তারই সূত্র ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে যথাযথ সমাধানের লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। সেই মহান জাতীয় দায়িত্ব যথাযথ পালন করা থেকে সরকার বা শাসকগোষ্ঠী আজ কেন দূরে সরে গিয়ে উল্টো পথে হাঁটছে? পার্বত্য চট্টগ্রামের বঞ্চিত জুম্ম জনগণ এই প্রশ্নের জবাব চায়!

আমরা খুব ভাল করে জানি যে, বিএনপি, জামাত ও অপরাপর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলো যারা এযাবতকাল ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য জন সমর্থন ছিল না। আজও তা নেই। বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের ভেতর কিছু সমর্থন থাকলেও বিপুল সংখ্যক বাঙালি ও পাহাড়ি সম্প্রদায় এই মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সমর্থন করে না। কারণ বিগত সময়ে তারা জানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও তাদের সহযোগীরা সরাসরি অবস্থান নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে। জামাত ও তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগীরা বাংলাদেশে কোনও অমুসলমান রাখতে চায় না। সেটাও অনেকটাই পরিষ্কার, সেই জামাতকে কোলে নিয়ে বিএনপি চারদলীয় জোট এক সময় ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়েছে, জামাতে ইসলামকে কোলে নিয়ে নির্বাচনীর মাঠ গরম করেছে। তার মানে হলো এই, জামাতকে এক সময় বিএনপি চারদলীয় জোট বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারে আওয়ামীলীগ সরকার কি কখনো নিশ্চুপ ও নিরপেক্ষ থেকেছে? না, তারাও নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি! কথা আছে, ‘যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবন।’ আওয়ামীলীগ সরকারও হেফাজত ইসলামকে কোলে নিয়ে অনেকটা পথ হেঁটেছে, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দল হেফাজত ইসলামকে আওয়ামীলীগ সরকারও বৈধতা দিয়েছে। বস্তুত আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই, তারা কার্যত একই মতাদর্শের ঝান্ডাধারী। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থায় চলে যাচ্ছে, তারপরও তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! পাহাড়ের এমন কঠিন বাস্তবতা মন দিয়ে গভীর উপলদ্ধি করার আন্তরিকতাসম্পন্ন মানুষ বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে আজ চরম সংকট রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে থেকেই চুক্তি বিরোধী, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চিরশত্রু জামাতে ইসলামী এবং তাদের অপরাপর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরোধিতা করে এসেছিল। তাদের এই চুক্তি বিরোধিতা এবং বিরোধিতা করতে গিয়ে নানাবিধ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চক্রান্তের অন্তর্গত ছিল। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ এই ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। এক সময় বিএনপি ও তার সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সহযোগীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে সর্বশেষ অবস্থান থেকে জেহাদের পর্যন্ত ডাক দিয়েছে। তাহলে এর চেয়ে আর সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ আর কিবা হতে পারে! তাদের এই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক আচরণ, ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর মতোই যে আচরণ, সত্যিকার অর্থে আমাদের জাতীয় জীবনে চরমভাবে ঘৃণার জন্ম দিয়েছে এবং ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আজও সেই ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদেরকে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে ফেরেছি বার বার! মুক্তির তরে আজও ক্লান্তিহীন পথচলা আজও থেমে নেই, ভালবাসি আজও প্রিয় মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে!
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যদিও দেশে-বিদেশে শান্তিকামী ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের দ্বারা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে, কিন্তু এর কাঙ্খিত ফলাফল পাহাড়ের মানুষ আজও পায়নি। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের অনেকে এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বিশ্বের যে সমস্ত দেশে এ-ধরনের এথনিক সমস্যা রয়েছে যা বহু বর্ষব্যাপী সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ভেতর আজও অব্যাহত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি সে সব দেশের জন্য অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। আজও কি সেই বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের অভিমত কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে? আজও তা পারেনি, বরঞ্চ চুক্তির আগের সময়ের ন্যায় আজও পাহাড়ের বুকে বারুদের ধোঁয়া, রাইফেল কাঁধে তুলে নেওয়ার পরিস্থিতি ও বাস্তবতা, অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা বিরাজমান রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আজও নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্দয়ভাবে সেনাশাসন জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসে আছে। রাত-বিরাতে চলছে সেনাবাহিনীর অভিযান, চলছে সাধারণ জুম্মদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি, চলছে নারী ধর্ষণ, হত্যা, লুঠপাট ও সাধারণ মানুষকে অস্ত্র গুজিয়ে দিয়ে সন্ত্রাসী সাজিয়ে গ্রেফতার ও অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানি।

চলছে বহুজাতিক কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপ, লাদেন গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, শামীম গ্রুপ, এস-আলম গ্রুপ, পিএইচপি গ্রুপ, মেরিডিয়ান গ্রুপ, বাবুল গ্রুপ, একমি গ্রুপ ও সিকদার গ্রুপদের কর্তৃক হাজার হাজার একর জুম্মদের ভূমি বেদখল, সেনাক্যাম্প ও বিজিবি ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে জুম্মদের জায়গা জবরদখল, পর্যটন, বিনোদন পার্ক ও হোটেল নির্মাণের নামে সাধারণ জুম্মদের উচ্ছেদ ও ভূমি বেদখল, বন ধ্বংসকরণ ইত্যাদি চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কাঙ্খিত সুফল কোথায়? দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ে বা দেশের জাতীয় নেতৃত্বের কাছেও আবেদন নিবেদন করে অনেকবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে ও প্রধানমন্ত্রী বরাবরেও অনেকবার ধর্না দিয়েছে তাতেও কোন কাজ হয়নি। এরপর কূটনৈতিক, লবিং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুরুব্বিদের মানবাধিকার সংগঠন, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। যাতে করে দেশের শাসকগোষ্ঠীর উপর আন্তর্জাতিকভাবেও বহুমুখী চাপ সৃষ্টি করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না করে বরঞ্চ প্রতি পদে পদে সরকার ও শাসকগোষ্ঠী চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই! আমরা কখনো যুদ্ধের প্রচেষ্টা করি না, নিজেকে রক্ষার হেতু প্রয়াস থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এমন চরম সংকটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যা পাহাড়ের মানুষকে আজ যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ আমরা অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধকে জয়যুক্ত করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু সংখ্যা দিয়ে কি বোঝা যায় নিরস্ত্র জুম্ম জনগণের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর বর্বরতা, জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনের হাহাকার, তাদের ঘৃণা ও ক্রোধ কতটা গভীর? বিশ্লেষণে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বছরের পর বছর একই ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যে শিশু আজ বড় হচ্ছে কিংবা হৃদয়ে এক বিরাট ক্ষত ও জখম নিয়ে বড় হচ্ছে সে হাতে অস্ত্র নেবে না তো কী নেবে? দখলদার, অত্যাচারী ও গণহত্যাকারীর বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের প্রতিরোধই যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি! জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধই পাহাড়ের জুম্ম জনগণের আরেক নাম। এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শুধুমাত্র আজ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে তা এমনটাই ঘটেছিল। যেখানে অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন হয়েছে সেখানে ন্যায়ের পক্ষে শোষিত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রাম হয়েছে। যেখানে শোষকদের নিপীড়ন ও শোষণের শৃঙ্খল তীব্রতর হয়েছে, সেখানে শোষিত ও নিপীড়িতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষকদের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা আজ মোটেই সুখকর নয়। রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা, নানিয়াচর, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী, বান্দরবানে প্রতিটি উপজেলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও যত্রতত্র সেনাবাহিনীর অভিযান, নির্যাতন ও অমানবিক শোষণের চলমান বাস্তবতা আমাদেরকে এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকতে দেয় না। একদিকে সাধারণ মানুষের উপর অমানুষিক শোষণ, অত্যাচার, অবিচার অপরদিকে রাত-বিরাতে প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর অপারেশন অভিযান, গ্রেফতার ও ধরপাকড় যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার চরম সংকটময় মুহূর্তে আমাদের জুম্ম জাতীয় জীবনে এক বুক হতাশা ও নিরাশা বিরাজ করছে। এই হতাশা আমাদের জুম্ম জাতীয় জীবনে দিন দিন বেড়েই চলেছে, যা একদিন ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলে মহাবিস্ফোরণ হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা নিয়ে সরকার, শাসকগোষ্ঠী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনা নেতৃত্ব যদি এগিয়ে না আসে তাহলে চুক্তির পূর্বের সময়ের ন্যায় পাহাড়ের পরিস্থিতি আরও সংঘাতময় অবস্থায় চলে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই!

দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস আজও আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ ভুলতে পারিনি। পাহাড় জুড়ে যখন যুদ্ধময় অবস্থা বিরাজ করছিল তখন পাহাড়ের জুম্ম জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সীমা ছিল না। সেই দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে আজও নিপীড়িত জুম্ম জনগণ প্রতিটি প্রহর গুণছে। যুদ্ধাবস্থা জারি থাকলে জীবন কীভাবে দুর্বিসহ হয়, কীভাবে আতঙ্কের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয় প্রতিটি প্রহর, কীভাবে সইতে হয় আপনজন হারানোর তীব্র বেদনা তা পাহাড়ের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলদ্ধি করতে পারে। আপনজন হারানোর বেদনা ও যন্ত্রণার চাপা গোঙানির আত্মচিৎকার পাহাড়ের বুকে আজও থামেনি, পাহাড়ের জীবন এখনও আমাদের নয়। মুক্ত ও নবজীবনের প্রত্যাশায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের পক্ষে জাতির অগ্র সেনানীরা বিগত দিনে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, পেছনে ব্যাগ-ভর্তি রসদ এবং কাঁধে রাইফেল ও নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির চেতনাকে অন্তরে সমর্পণ করে শতভাগই জুম্ম জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে লড়াই সংগ্রামে সামিল হয়েছিল। তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল কেবল নিরন্ন খেটে-খাওয়া জুম্ম জনগণের মুক্তি। পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছিল নিরন্তর গতিতে, মেশিনগানের শব্দের তালে তালে যুদ্ধের ময়দান রণতূর্যে ভরপুর করে রেখেছিল সেদিন। হাজারো দুঃখ আর কষ্টকে সেদিন কষ্ট বলে মনে করেনি, সেই কষ্টগুলোকে কষ্টিপাথরের ন্যায় আপন করে নিয়েছিল। অথচ অবর্ণনীয় দুঃখ আর কষ্ট থেকে জুম্ম জনগণের আজও মুক্তি মেলেনি এবং নিপীড়িত ও শোষিত জুম্ম জনগণের মুক্তির লড়াই আজও চলমান। ন্যায়ের যুদ্ধ, লড়াই সংগ্রাম দীর্ঘজীবী হোক!