হিল ভয়েস, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, চট্টগ্রাম: গতকাল ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, মঙ্গলবার, বিকাল ৩ টায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চত্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে চুক্তি যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’এর উদ্যোগে এক সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের সভাপতিত্বে এবং বাাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহানের সঞ্চালনায় সংহতি সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাসদ’এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক রণজিৎ দে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য সৌখিন চাকমা, জাসদ কেন্দ্রীয় নেতা জসিম উদ্দিন বাবুল, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঐক্য ন্যাপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুন রশিদ ভুঁইয়া, ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিঠুল দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য অ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রতিনিধি অলিক মৃ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সুমন মারমা।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন বলেন, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই শান্তি প্রক্রিয়া আমরা শুরু করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমি উদ্বিগ্ন। এই পাহাড় এখন অশান্ত। শুধু তাই নয়, পাহাড়ের অশান্তিকে ঘিরে এই চট্টগ্রামে ও সারাদেশে অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আপনারা দেখেছেন, গত কয়েকমাস ধরে ওই পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে জঙ্গী মৌলবাদীরা সেখানে সশস্ত্র ট্রেনিং নিচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে হামলা চালানোর জন্য। অর্থাৎ পাহাড়ের অশান্তি এখন সারাদেশের অশান্তি। আমি অবাক হয়ে যাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পার্বত্য শান্তি চুক্তির ফলে ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার পান। আশা ছিল এই চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদাহরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা হয়নি। বহুবার সরকারের কাছে আবেদন করেছি। ওই পার্লামেন্টে পার্বত্য ভূমি কমিশন আইন প্রণয়ন করার জন্য। যতবার পার্লামেন্ট থেকে আমরা বিবৃতি দিয়েছি ততবার আমলাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা হাজির করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল ভূমি কমিশন আইন করতে। ৩০ হাজার আবেদন পড়েছে ভূমি কমিশনে, একটিও নিষ্পত্তি করা হয়নি। তাহলে যে আইনে যে সমস্যার সমাধানের কথা ছিল তা আমরা করছি না।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান পার্বত্য সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা নেয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তারা সেদিন সাধারণ নিরীহ মানুষকে এনে অভিবাসী বানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তিতে তাদের পুনর্বাসনের কথা ছিল। তা দূরে থাক, আজ এ বিষয় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়ে কথা বলতে পারবেন না। আমরা যখন গেছি হরতাল দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। ড. কামাল হোসেন, ঐক্য ন্যাপ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ আমাদের আটকে দেয়া হয়। সেখানে গিয়েছিলাম, ডিসি সাহেব বলেন, আপনারা বেশি আলোচনায় যাবেন না। আমি বললাম, চুক্তি সরকারের, দেশ সরকারের আর আপনি এ কথা বলছেন। আজকে পাহাড়ে আমরা দেখি অলিখিত সামরিক শাসন। সেখানে শুধু সেনাবাহিনী নয়, এপিবিএন, নতুনভাবে পুলিশের ক্যাম্প করা হচ্ছে। এই পাহাড় দেশের এক দশমাংশ। একদিন খালেদা জিয়া বলেছিল, চুক্তি করে এক দশমাংশ শেখ হাসিনা ভারতের হাতে তুলে দিবে। ৩০ বছর হয়েছে তা হয়নি। আজ যদি সরকারও একই যুক্তি দেয়, একই ধরনের বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন, তাহলে পাহাড়ে কখনো শান্তি আসবে না।
তিনি আরও বলেন, শুধু পাহাড়ের মানুষ নয়, মূল স্রোতের সব মানুষকে এ দাবিতে এক হতে হবে। পাহাড়ি বাঙালি মিলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করব। এটা আমাদের দায়িত্ব।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কেন্দ্রীয় সদস্য সৌখিন চাকমা বলেন, দীর্ঘ দুই যুগের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পেয়েছি। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল পাহাড়ে শান্তি আনয়ন করা এবং অধিকারহারা পার্বত্য জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু ২৫ বছরেও চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুম্ম জনগণ এখনো শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। সরকার চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ না নিয়ে বরঞ্চ চুক্তি বিরোধী নানা চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে এবং চুক্তি পরিপন্থী নানা গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। চুক্তি বাস্তবায়নে লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে। এই ঐতিহাসিক চুক্তিকে সরকার যেভাবে পদদলিত করছে আমরা খুবই হতাশ যে, অতি সন্নিকটে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, চুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে সরকার অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই চুক্তি শুধু আমাদের নয়, এই চুক্তি বাংলাদেশের সকলের। তাই চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
সিপিবি’র সভাপতি কমরেড শাহ আলম বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর হয়ে গেল। এখনো সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যে সরকার এই চুক্তি করেছে সে সরকার আজ ১৪ বছর ক্ষমতায়। তারা বাস্তবায়ন করছে না কেন? তাহলে সরকারের মধ্যে অন্য কোনো সরকার আছে কিনা? তারা কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়েও বড়? না হলে কেন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারছে না। চুক্তির পক্ষে আমরা ছিলাম। বাস্তবায়নের ৫ দফার সাথে আমরা আছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়ন করা দরকার।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর সাধারণ সম্পাদক বজলুল রশীদ ফিরোজ বলেন, পাহাড় ও সমতলের এদেশে যে আদিবাসীরা আছেন আমাদের সংবিধান তাদেরকে এখনো নাগরিক হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়নি। আজকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের উপর যেমন ষড়যন্ত্র করছে, একইভাবে অধিকারহীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীকেও দমিয়ে রেখেছে। পাহাড়ের মানুষ জুম নির্ভর। তাদের কোনো জমির দলিল-দস্তাবেজ থাকে না। তাদের সেই জমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সরকারের সেদিকে নিজের নজর নেই। এটা স্পষ্ট যে, সরকার পাহাড়ের সমস্যার সমাধান চায় না। তাই চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগও গ্রহণ করছে না। লড়াই সংগ্রাম করে যেমন চুক্তি সম্পাদন করতে বাধ্য করা হয়েছে সরকারকে, একইভাবে এই চুক্তি বাস্তবায়নে আরও বৃহত্তর আন্দোলন করতে হবে।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, যে রাষ্ট্র চুক্তি করে সেই চুক্তির ভঙ্গের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমরা সে রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করিনি। নারী, দলিত, সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার আকাক্সক্ষার মধ্য দিয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়। সরকার বলছে, চুক্তির এত এত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা অংকের হিসাব বুঝি না, আমরা মানুষের অধিকার বুঝি। পাহাড়ে রক্তপাতের জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী সেটা আমরা জানি। কিন্তু সরকার বলছে, পাহাড়িদের মধ্যেকার বিরোধের কথা। পার্বত্য চুক্তি কেবল পাহাড়ি জনগণের না, এই চুক্তি দেশের সার্বভৌমত্বেরও।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী জাকির হোসেন বলেন, পাহাড়ের সমস্যা কেবল পাহাড়িদের না, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। পাহাড়িদের অধিকারের আন্দোলনে আমাদের বাঙালিদের যেভাবে সক্রিয় থাকার কথা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই আন্দোলন পাহাড়িরাই করছে। চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর উদযাপন হওয়া উচিত ছিল আনন্দঘন পরিবেশে। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। কারণ পাহাড়ি জনগণ তাদের কাক্সিক্ষত অধিকার ফিরে পায়নি। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তাছাড়া তিনি চুক্তির যথাযথ ও দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সূচীভিত্তিক একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, মূলধারার জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, সমর্থন, সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সহজে হবে না। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রশ্নে নিরব। শুধু পাহাড়ে নয়, সমতলেও আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের ভূমি হারাচ্ছে। বড় দলগুলোর এসব প্রশ্নে ভূমিকা দেখি না। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে নতুন জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে। যদি একটি অঞ্চলকে আমরা অশান্ত রাখি এবং স্বাভাবিক জীবনকে বানচাল করে রাখি সেই অঞ্চল অস্থিতিশীল হতে বাধ্য।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন কর্তৃক আয়োজিত সমাবেশে গণ সঙ্গীত পরিবেশন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রঁদেভূঁ শিল্পী গোষ্ঠী শিল্পীবৃন্দ। সংহতি সমাবেশ শেষে গণমিছিল নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে সরকারের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ৫ দফা দাবি জানানো হয়।