পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে: খুলনায় মতবিনিময় সভায় বক্তাগণ

0
217

হিল ভয়েস, ২৭ মে ২০২৪, বিশেষ প্রতিবেদক: গত পরশু (২৫ মে) ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ কর্তৃক খুলনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংহতি মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পাহাড়ের জুমিয়া মানুষদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে এবং পাহাড়ে আজ ছোট-বড় সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে।

বিকাল ৩ টায় খুলনা প্রেসক্লাবের হুমায়ুন কবির বালু মিলনায়তনে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সম্মিলিত বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলুন’ এই শ্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ‘চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ এর খুলনার সমন্বয়কারী খালিদ হোসেন।

সভায় আলোচনায় অংশ নেন চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ জাসদ স্থায়ী কমিটির সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বাবু, রফিকুল হক খোকন, স্থায়ী কমিটির সদস্য এস এ রশিদ, ওয়ার্কার্স পাটির্র খুলনা মহানগর সভাপতি মোফিদুল ইসলাম, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার উদ্দিন দিলু, খুলনা মহানগর জাসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মিন্টু, যুব জোট এর খুলনার সভাপতি মাসুদ রানা ও সাধারণ সম্পাদক তানভির হোসেন সেন্টু, বাংলাদেশ জাসদ এর খুলনা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মো. হাসান, বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য হিরা শেখ, নারী জোট এর খুলনার সভাপতি রুনা লায়লা, যুব মৈত্রী’র খুলনার সভাপতি প্রভাষক রেজায়ুন রাজা ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. কামরুল হোসেন জোয়ারদার, বাসদের জেলা সদস্য সচিব কহিনুর আক্তার, আব্দুল করিম, অ্যাড. সন্দিত মন্ডল, নাগরিক নেতা এ্যাড. বাবুল হাওলাদার, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’র খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাড. মমিনুল ইসলাম, ব্লাস্ট খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাড. অশোক কুমার সাহা, জন উদ্যোগের মহন্দ্রেনাথ সেন, বেলা’র খুলনার সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন কবির ববি, সাজ্জাদুর রহমান পান্থ প্রমূখ। এসময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ২৬ বছর অতিক্রম হওয়ার পরেও সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে পাহাড়ের জুমিয়া মানুষদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে আজ পাহাড়ে নানা ধরনের বিভিন্ন ছোট-বড় সন্ত্রাসী ও জঙ্গী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। যা পাহাড়ি অঞ্চলকে অশান্ত করে তুলেছে। তাই সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া।

বক্তারা আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যেমন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ঠিক তেমনি পাহাড়ের চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াইও শুধু পাহাড়িদের নয়, এই লড়াই সমগ্র দেশবাসীর লড়াই। তাই সারা দেশে চুক্তি বাস্তবায়নের সপক্ষে জনমত গঠন করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের সংগ্রামকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে।

সভায় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে দেশের অপরাপর অঞ্চলের ন্যায় অতিশীঘ্রই খুলনাতেও চুক্তি বাস্তবায়নের সপক্ষে গণমিছিল ও সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়।

মতবিনিময় সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করে পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ৫ দফা এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য ২টি পৃথক দাবি উত্থাপন করা হয়।

পার্বত্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য দাবিগুলি হল:

১. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে চুক্তির দ্রুত ও যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

২. পাহাড়ে সামরিক কর্তৃত্ব ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের স্থায়ী অবসান করতে হবে।

৩. আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক করা এবং স্থানীয় শাসন নিশ্চিত করতে পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক এসব পরিষদের যথাযথ ক্ষমতায়ন করতে হবে।

৪. পার্বত্য ভূমি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকরের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের পুনর্বাসন করে তাঁদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৫. দেশের মূল স্রোতধারার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

সমতলের আদিবাসীদের জন্য দাবি সমূহ:

১. ইউনিয়ন পরিষদ সহ সকল স্তরের স্থানীয় সরকারে সমতলের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ এবং আদিবাসী জনগণের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

২. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসীদের অধিকারের স্বপক্ষে দেশে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করার লক্ষে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে এই প্ল্যাটফর্মটি। গঠনের পরপরই এর উদ্যোগে গত ২০ ডিসেম্বর ২০২২ ঢাকায় প্রথমবার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে গণমিছিল ও সংহতি সমাবেশের আয়োজন করে। তারপর এপর্যন্ত চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সহ আদিবাসীদের অধিকারের স্বপক্ষে বিভাগীয় গণসমাবেশ ও গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ঢাকায় একাধিক জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

২৫ মে, খুলনার মতবিনিময় সভা উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বলা হয়, “পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি জুম্ম আদিবাসী অধ্যুষিত বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলে স্মরণাতীত কাল থেকে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে আসছে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও ১৯৭২ সালের সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান রচনার সময় তাদের পরিচয়কে অস্বীকৃতির মাধ্যমে এইসব সমৃদ্ধ আদিবাসী জাতিসমূহকে রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়।

এমনি বাস্তবতায় দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র সংঘাতের অবসানে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। আমরা আশা করেছিলাম, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এইসব আদিবাসী জাতিসমূহকে অস্বীকারের মধ্য দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভুল এই রাষ্ট্র করেছিল তার পথ কিছুটা হলেও বাতলে দেবে এই স্বাক্ষরিত চুক্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছরেও এই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও বিকাশের কাজটি এখনো অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

পার্বত্য সমস্যাকে জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা সম্ভব নয়। এই মর্মবাণীকে উপলব্ধি করে এবং পাহাড়ের জুম্ম আদিবাসীদের ঐতিহাসিক দাবি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সম্মিলিত প্রয়াসে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন’ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে।”