পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে দুই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৪টি চাকমা সংগঠনের স্মারকলিপি

0
531

হিল ভয়েস, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং সফররত বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চারটি চাকমা সংগঠন স্মারকলিপি প্রদান করেছেন যাতে তারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ জানান।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ৪ দিনের সফরে আজ (সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর) নয়াদিল্লি পৌঁছেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ সময়ে চাকমা ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার (সিএনসিআই) মিজোরাম শাখা, ত্রিপুরা রেজ্যো চাকমা গাবুজ্য যোধা, চাকমা হাজং রাইটস অ্যালায়েন্স এবং চাকমা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া (সিডিএফআই) নামে চারটি চাকমা সংগঠন সিএনসিআই-এর রসিক মোহন চাকমা, গাবুজ্য জোধা-এর প্রিয় রঞ্জন চাকমা, চাকমা হাজং রাইটস অ্যালায়েন্সের প্রীতিময় চাকমা এবং সিডিএফআই-এর সুহাস চাকমার স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি দুই প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে পাঠানো হয়েছে৷

৪টি অধিকার সংগঠনগুলো ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে শান্তির অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হলেও, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পরও চুক্তির মূল বিধানগুলি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। মূল বিধানের মধ্যে রয়েছে-

(১) বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের আইন-শৃঙ্খলা ও তত্ত্বাবধান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ধারা ৯ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কাছে অন্যান্য সম্পর্কিত বিষয় হস্তান্তর করা;

(২) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৭নং ধারার মোতাবেক সংঘাত চলাকালীন সময়ে স্থাপতি সেনা ক্যাম্পসমূহ তিনটি জেলা সদরের সেনানিবাস এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা সেনানিবাসে গুটিয়ে নেয়া;

(৩) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যান্য বিষয়াদি সংক্রান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ধারা অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি করা; এবং

(৪) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যান্য বিষয়াদি সংক্রান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ধারা অনুযায়ী ভারত থেকে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা।

আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুত্বের উপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয় না।

সমষ্টিগতভাবে জুম্ম নামে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যকার নাগরিক অসন্তোষ ছাড়াও, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রায়ই বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত করা হয়ে থাকে।

অধিকন্তু, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে সশস্ত্র সংঘাত, মায়ানমার কর্তৃক ১৫ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে বিতাড়ন এবং এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কাউকে প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের অস্বীকৃতির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম আজ সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে উৎস পরিণত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বশাসনের ক্ষমতায়নের ফলেই আদিবাসী জুম্ম জনগণের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কেবল এই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বা এই অঞ্চলটিকে বিভিন্ন বিদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য ব্যবহার করার সুযোগ করে দেওয়া বাংলাদেশ, ভারত এবং আদিবাসী জুম্ম জনগণের স্বার্থ পরিপন্থী৷

এই পটভূমিতে ৪টি চাকমা সংগঠন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপরে উল্লিখিত অ-বাস্তবায়িত মূল বিধানগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আহ্বান করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের যদি প্রয়োজন মনে করে এবং ইচ্ছা ব্যক্ত করে থাকে তাহলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন চাকমা নেতারা।

চাকমা সংগঠনগুলোর অভিমত যে, ভারত সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে একটি অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করা, যার মধ্যে রয়েছে ভারত থেকে প্রত্যবাসিত জুম্ম শরণার্থী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু ব্যক্তিদের হারানো জায়গাজমি ফেরত দেওয়া ও পুনর্বাসন করা। যেমন করে জাতিগত তামিলদের সাথে সশস্ত্র সংঘাতের অবসানের পর শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু ব্যক্তিদের ভারত কর্তৃক অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল।

অবশেষে এসব অধিকার সংস্থাগুলি আরও জোর দিয়েছে যে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে নাগরিক অস্থিতিশীল অবস্থা অবসানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতি, এবং আদিবাসী জুম্ম জনগণের অন্যান্য পক্ষগুলোর সাথে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এবং ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মূল্যায়নসহ শান্তি প্রতিষ্ঠার সুবিধার্থে উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা।