পার্বত্য চুক্তি নিয়ে তাত্ত্বিক ভাবনাঃ ফিরে দেখা বিগত ২২ বছর

0
1519

               অনুরা চাকমা               

আগামীকালকের সূর্যোদয়ের সাথে পার্বত্য চুক্তির ইতিহাসে ২২ বর্ষপূর্তি যোগ হবে। কিন্ত শুরুতেই প্রশ্ন থেকে যায়, পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে পাহাড়ের মানুষ চুক্তির অনেক বছর পরে কি পেয়েছে আর চুক্তি মোতাবেক এখনো কি পায়নি। সরকারের মতে, পার্বত্য চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে, চুক্তির অপরপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দাবি করে ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবনায়ন হয়েছে, বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক ধারাসমূহ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

পার্বত্য চুক্তির উভয়পক্ষের হিসাব বাদ দিলে, চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে জনগণের হিসাব কি বলছে? বিগত সময়ের গবেষণা কি বলছে? পৃথিবীর শান্তি চুক্তি নিয়ে গবেষণা করা একাডেমিক জগতে স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান Notre Dam University-এর Kroc Institute-এর মতে, পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের হার মাত্র ৪৯%। আপনারা এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, সেটা গবেষণাতে হতেই পারে, কিন্ত আমাদের ততক্ষণ পর্যন্ত এই গবেষণার ফলাফলকে বিশ্বাস করতে হবে যতক্ষণ আমরা আরেকটা নতুন গবেষণার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আলোচনায় না আসি।

বিগত ২২ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চুক্তি নিয়ে অনেক গবেষণাধর্মী বই এবং নামী-দামী জার্নালে কমপক্ষে হলেও কয়েক ডজন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশ গবেষণায় পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অসন্তোষজনক ফলাফল এসেছে।আমরা হয়তোবা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক, দলীয় এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে প্রত্যাখান করতে পারি, কিন্ত অনেক গবেষণার ফলাফল কিভাবে উড়িয়ে দিতে পারি?

আমি আমার পিএইচডি গবেষণায় জানার চেষ্টা করছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের নেতৃত্বের পরিবর্তন (Leadership turnover) এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তন (Ideological turnover) কিভাবে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে (ইতিবাচকভাবে এবং নেতিবাচকভাবে) প্রভাবিত করতে পারে। বিগত নয়টি মাসে Literature review করতে গিয়ে শান্তিচুক্তি নিয়ে অনেক গবেষক এবং স্কলারদের নানা ধরনের বিশ্লেষন জানার সৌভাগ্য হয়েছে এবং আমি আমার Literature review-এর সামান্য অংশ তুলে ধরলাম।

Fearon, Hampson, Jarstad & Nilsson, Beardsly এবং অনেক স্কলার তাদের গবেষণায় শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক উপাদানের (যেমন, গণতন্ত্রের ভূমিকা, চুক্তির ধরন, চুক্তিবিরোধী অপশক্তির ভুমিকা, বিদেশী রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা ইত্যাদি) প্রভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। Brunborg & Urdal, Collier & Hoeffler, Murshed & Gates, Stewart, Graham & Langer-সহ অনেক স্কলার গবেষণা করে দেখেছেন কিভাবে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণ (যেমন, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা এবং মানব উন্নয়ন ইত্যাদি) শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করে।

অন্যদিকে Brunborg & Urdal-দের মতে, জনসংখ্যার চাপ এবং বহিরাগতদের বসতি স্থাপন শান্তি প্রক্রিয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে। Do & Iyer-দের বিশ্লেষণ অনুসারে, জাতিগত বিভেদের কারণে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবেও শান্তি প্রক্রিয়া ধূলিসাৎ হতে পারে। সংক্ষিপ্ত করে বলব, কেন অনেক দেশে শান্তি চুক্তি বাস্তনায়ন হয়েছে আর কেন অনেক দেশে শান্তি চুক্তি ব্যর্থ হয়েছে – এ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত গবেষণা হয়েছে।

তাই চুক্তি নিয়ে অনেক ধরনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে আসা যায় কিন্ত আমি আমার আলোচনার সীমারেখা টানব একটি তাত্ত্বিক জায়গায় – সেটা হল Johan Galtung-এর Negative-Positive Peace ধারনা। এই তাত্ত্বিক ধারনার মূল বক্তব্য হল, একটি দেশেকিংবা একটি অঞ্চলে নেগেটিভ পিস (সশস্ত্র সহিংসতার অনুপস্থিতি) বিদ্যমান আছে কিন্ত পজিটিভ পিস যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, দারিদ্র্য, জাতিগত-ধর্মীয় বৈষম্য, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং পরিবেশের বিপর্যয় চলমান আছে। আমরা কি সেই রাষ্ট্র কিংবা সমাজকে “শান্তিপূর্ণ” বলতে পারব?

আমি এই লেখায় পার্বত্য চুক্তিকে কেবল মাত্র Negative-Positive Peace তাত্ত্বিক ধারনা দিয়ে এবং সঙ্গতিপূর্ণ বিদ্যমান গবেষণার রেফারেন্সের আলোকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। তবে এটা বলে রাখা দরকার, Constructivists-দের মতে, সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা এবং বিশ্লেষণ শুধুমাত্র একটি বিষয়ের আংশিক সত্যকে (Partial truth) উপস্থাপন করতে পারে এবং এই সত্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সত্য (Absolute truth) থেকে আলাদা। এ কারণে, যুক্তিতে ভরপুর তর্ক-বিতর্ক সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়সমূহকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং আমার এই আলোচনাটাও তাই বিতর্কের বাইরে যেতে পারে না।

প্রথমে আলোচনা করি নেগেটিভ পিস নিয়ে। একটি অঞ্চলে কিংবা দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সশস্ত্র সংঘাত-রক্তপাত বন্ধ হলে আমরা সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাকে “শান্তিপূর্ণ” বলি। এবার আপনারা বলেন, আমরা কি পার্বত্য চট্টগ্রামে “নেগেটিভ পিস” দেখতে পাই? পার্বত্য চুক্তির পরে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে শান্তিবাহিনীর যুদ্ধ সমাপ্তি হয়েছে। কিন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের ধরন, কারণ, ফলাফল এবং প্লেয়ারের পরিবর্তন হয়েছে। একটি যুদ্ধের কবর রচনা হয়েছে, কিন্ত একই সাথে অনেক যুদ্ধের সূচনা হয়েছে, অনেক প্লেয়ারের জন্ম হয়েছে। চুক্তির পরে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে ৫০০ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে এবং ১০০০ জনের বেশি অপহরণের শিকার হয়েছে।

অন্যদিকে অনেক উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনের (যেমন সমঅধিকার আন্দোলন এবং পার্বত্য বাঙালি গণ পরিষদ) জন্ম হয়েছে যারা ভূমি সমস্যা এবং চুক্তির অপব্যাখ্যা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে চাঙ্গা করছে যেটার প্রতিফলন আমরা চুক্তি-উত্তর অনেক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলোতে দেখতে পাই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা সমস্যা। মোট কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবেঃ পাহাড়ে কারা (বিশেষ ব্যক্তি/ রাজনৈতিক দল/ সরকারী সংস্থা) পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন আর পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে কারা শান্তি চায় না?

এখন আসেন পজিটিভ পিস প্রসঙ্গে। International Work Group for Indigenous Affairs (IWGIA), Amnesty International, Kapaeeng Foundation, Chittagong Hill Tracts Commission, Braithwaite & D’Costa, Jamil & Panday, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এবং গবেষকদের মতে, পার্বত্য চুক্তি প্রত্যাশা অনুযায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারীর প্রতি সহিংসতা, আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ, বনভূমি ধ্বংস, পাহাড় কাটা, পাথর উত্তোলনসহ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হচ্ছে। IWGIA-এর মতে, ২০০৪-২০১১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মন্দির ভেঙে দেয়া, বিনা অপরাধে গ্রেফতার এবং আদিবাসী নারী ধর্ষণসহ ১৪৮৭টি বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক হল, সরকার শান্তিবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তাসহ যথাযথ পুনর্বাসন করতে পারেনি। যার ফলে Disarmament, Demobilization and Reintegration (DDR) পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অপরদিকে ভারত থেকেপ্রত্যাগত শরণার্থীদের একটি বিশাল অংশ নিজেদের জমি ও বসত-ভিটায় ফেরত যেতে পারেনি।

সেই সাথে রয়েছে “সামরিকীকরনের” সমস্যা। Braithwaite & D’Costa-দের পর্যবেক্ষণ তাদের গবেষণা প্রবন্ধ থেকে হুবহু তুলে ধরলামঃ “But the military proved a bad faith supporter of the peace. Once its objectives of surrender of most weapons, closure of the Tripura insurgent bases, and return of the JSS leadership to their martial control and surveillance was accomplished, successive military leaderships from 1998 to the present mobilised the political power of the military to defer, delay and ultimately deny implementation of key elements of the 1997 agreement. Initially, dozens of temporary military camps were closed in the CHT to implement the demilitarisation part of the agreement, but effective re-militarisation of the CHT was ultimately asserted with slightly fewer military and more police, intelligence and auxiliaries under military.”

দেশের এই অঞ্চলটা এতটা “সামরিকীকরন” করা হয়েছে, যেখানে চুক্তি পরিপন্থী “অপারেশন উত্তরণ” চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি দশজন মানুষের বিপরীতে একজন আইন-প্রয়োগকারী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এটার সাথে র‍্যাবের একটি ব্যাটালিয়ন যোগ হতে যাচ্ছে। আর কত? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে একটিসেমিস্টারে Barry Buzan-এর “People, States and Fear” বইটি পড়িয়েছিলাম। Critical Security Studies-এর স্কলারদের অন্যত মযুক্তি হল, রাষ্ট্র যখন নিরাপত্তা বাড়ায়, তখন জনগণের নিরাপত্তা কমে যায়। রাষ্ট্র কেবল তার জনগণের নিরাপত্তা দেয় না, সেই সাথে জনগণের নিরাপত্তার সমস্যাও তৈরি করে। বিভিন্ন সরকারের আমলে দেশের বিরোধী মতকে দমন তার একটি মাত্র উদাহরণ। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, গাজা, মিন্দানাও, পাটানি এবং আরাকানসহ বিশ্বের অনেক অঞ্চল প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের “জাতীয় নিরাপত্তার” ধারণা কিভাবে “স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তাকে” ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে।

তবে এটাও আমাদের স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের ইতিহাসে একটি কালজয়ী ইতিহাস। আমি বিশ্বের অনেক দেশের চুক্তি অধ্যয়ন করেছি কিন্ত পার্বত্য চুক্তি আসলে একটি শ্রেষ্ঠ জাতীয় উপহার। কারণ এই চুক্তিতে সব কিছু যেমন রাজনৈতিক স্বশাসনের অধিকার, নারীদের অংশগ্রহণ, আদিবাসী ভূমি অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, পুলিশ এবং জনপ্রশাসন নিয়ে অনেক কিছু লেখা আছে। এরকম একটি শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক চুক্তি ২২ বছরেও অনেকটা অকার্যকর থেকে যাবে, মাত্র চারটি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, একটি দুর্বল ভূমি কমিশনের বারান্দায় ঝুলে যাবে, ভাবলে আক্ষেপ হয়! কারণ এই চুক্তি আমাদের আবেগের।

আমার মতো অনেকে জানেন, এই চুক্তি না হলে, পাহাড়ের বর্তমান প্রজন্মের অনেকে আজ হয়তোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা, ব্যাংকার, এনজিও কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ আর অনেক ধরনের সন্মানজনক সামাজিক অবস্থানে আসতে পারত না। আমি এটাও বলতে দ্বিধা করব না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন এবং আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থাসহ অনেক কিছু করেছে যদিও এখনো অনেক সমস্যা বিদ্যমান আছে। শেষ করব এই বলে, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং পর্যটন কেন্দ্রসহ আমরা সব কিছু চায়, তবে সব কিছুর আগে চুক্তির ১০০ ভাগ বাস্তবায়ন জরুরি।

অনুরাগ চাকমা: সহকারি অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তারিখ: ১ ডিসেম্বর ২০১৯।