পার্বত্য চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তিতে জাতীয় নেতৃবৃন্দ-‘২৩ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক, অথচ দেশের স্বার্থে চুক্তি বাস্তবায়ন অপরিহার্য’

0
900

হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২০, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ দেশের রাজধানী ঢাকায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় জাতীয় নেতৃবন্দ বলেন, ‘২৩ বছরেও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। অথচ দেশের স্বার্থে চুক্তি বাস্তবায়ন অপরিহার্য।’ নেতৃবৃন্দ রোডম্যাপ ঘোষণাপূর্বক অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক স্রোতধারায় থাকতে হবে। বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা ও সমুন্নত করতে হবে।’

আজ সকাল ১০:৩০ ঘটিকায় ঢাকার ধানমন্ডির উইমেন্স ভলান্টারি এসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ)এর মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ একথা বলেন।

ফোরামের সদস্য মেইনথিন প্রমীলার সঞ্চালনায় এবং সাধারণ সম্পাদক ও লেখক সঞ্জীব দ্রং এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর কেন্দ্রীয় সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজীম তিতিল প্রমুখ। এছাড়া অনলাইনে যুক্ত হয়ে উক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং বক্তব্য রাখেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন ও সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা।

স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক পল্লব চাকমা বলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে, চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হতে পারেনি। আঞ্চলিক পরিষদকে অকার্যকর অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় পুলিশ, পর্যটন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। চুক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট ব্যতীত অস্থায়ী সেনাক্যাম্পগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। দুঃখের সাথে বলতে হয়, ক্যাম্প তো সরানোই হয়নি বরং ইদানিং নিরাপত্তা ও সংঘাতের অজুহাত দিয়ে নতুন করে ক্যাম্প স্থাপন করা হচ্ছে। আজ ২৩ বছরেও চুক্তি মোতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন দিতে পারেনি।’ সরকার যে দৃঢ়তা নিয়ে চুক্তি করেছিল সেই দৃঢ়তা নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন অনলাইনে সংহতি জানিয়ে বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বর্ষপূর্তি একটি আনন্দের দিন ছিল। এখন আনন্দ করার বাস্তবতা আছে কিনা আমি জানি না। পাহাড়কে এখন সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সামরিক সমাধানের মাধ্যমে নয় রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাধান খুজতে হবে।’

সাংসদ মেনন আরো বলেন, ‘চিম্বুকে ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ প্রচেষ্টা আমার বোধগম্য নয়। পর্যটন সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নয়। সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভূমি সমস্যার সমাধান করা অতীব জরুরী।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ বাস্তবতাও চুক্তি বাস্তবায়নে প্রভাবিত করছে। পাহাড়ে যদি অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় তাহলে সেখানে পর্যটন হোক বা যে কোন ধরনের উন্নয়ন হোক কোন কিছুই টেকসই হবে না।’

প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্যন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক একটি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত রীতি ও পদ্ধতি অনুসারে পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান মোতাবেক গত ২৩ বছরে একটি বিরোধও নিষ্পত্তি হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘চুক্তি নিয়ে সময়ক্ষেপণ ও তালবাহানা করা হচ্ছে। কার্যত ভূমি কমিশনকে অকার্যকর করে রেখেছে সরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৩ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো অবাস্তবায়িত থাকার পাশাপাশি বিশেষভাবে সাম্প্রতিক সময়ে জুম্মদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আবারও নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী হতাশ ও বিক্ষুব্ধ, দেশের নাগরিক হতাশ ও উদ্বিগ্ন। কার্যত পাহাড় আজ অশান্ত ও অবরুদ্ধ।’

সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা বলেন, ‘আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু সেটা হতে পারছে না। রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যেও আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাব দেখতে পাচ্ছি। এটা দুঃখজনক।’ তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই। আমলারাই এখন দেশ চালাচ্ছে। এ বাস্তবতায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ছে।’

কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজীম তিতিল বলেন, ‘সত্য আড়াল করে রাখা যায় না। বাংলাদেশে গণমানুষের আকাঙ্খা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এ অভিযোগটা সত্যি যে, পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্পগুলো সরানো হয়নি, বরং সেনাশাসন জোরদার করা হয়েছে। পাহাড় কেটে, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কেন পর্যটন করা হবে? এ বিষয়গুলোর সুরাহা হতে হবে। অন্যথায় সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।’

বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘উন্নয়নের নামে বৈষম্য চলছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চুক্তি করে চুক্তি না মানা খুব দুঃখজনক।’ তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা কাল্পনিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চুক্তি নিয়ে আজকের পত্রিকাগুলোর খবরগুলো দেখলে বুঝা যায়। এভাবেই পার্বত্য পরিস্থিতিকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে এবং চুক্তি নিয়ে তালবাহানা করা হচ্ছে। কিন্তু চুক্তি কার্যকর ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের দায়িত্ব।’

সাংবাদিক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চুক্তি করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হয়েছিল তেমনি বাস্তবায়ন করতেও বাধ্য করতে হবে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি কর্তৃত্ববাদের একটি প্রতিযোগীতা।’ তিনি বলেন, ‘ম্রোদের উচ্ছেদ করে রিসোর্ট করা হবে সেটা মানা যায় না। রাষ্ট্রের উচিত এগুলো বন্ধ করা।’

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘বহুজাতির দেশ বাংলাদেশ। এটাকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সবাইকে সাংবিধানিকভাবে বাঙালি করা হয়েছে। অন্য জাতিগোষ্ঠীরা উপেক্ষিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোতে কোন সময়েই হাত দেওয়া হয়নি। বাস্তবায়ন অনেক দূরে। ভারত থেকে প্রত্যাগত অনেক জুম্ম শরণার্থী এখনো পুনর্বাসিত হতে পারেনি। সেটেলার বাঙালিরা তাদের জায়গা-জমিগুলো দখল করে রেখেছে। এর সমাধান রাষ্ট্রকে অবশ্যই করতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘সরকার বলছে চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু পাহাড়িরা বলছে চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়নি। আমার মনে হয় এখানে একটা ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পরিপূরণে আবার নতুন করে সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘২৩ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। যে অপেক্ষা করে সে জানে সময়টা কত দীর্ঘ। কোন নাগরিক যদি কষ্টে বা সংকটে থাকে সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’ আগামী ২ দুই বছরে চুক্তি পরিপূর্ণ ও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হোক-সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

রাঙ্গামাটি:

‘চুক্তি বাস্তবায়ন না করে পরিস্থিতিকে অন্যদিকে ধাবিত করা হচ্ছে’-রাঙ্গামাটির আলোচনায় ঊষাতন তালুকদার।

পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাঙ্গামাটিতে আয়োজিত আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর সহ-সভাপতি ও সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়ন না করে পরিস্থিতিকে অন্যদিকে ধাবিত করা হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি করে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে সরকার।’
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে এমন পর্যায়ে ফেলে রাখা হয়েছে-যার বাস্তবায়নও নেই, বাতিলও করা হয়নি। এ চুক্তিকে এখন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তি নিয়ে এখন ষড়যন্ত্র চলছে।’ তিনি বিষয়টিকে গভীরভাবে আমলে নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আজ সকাল ১০:৩০ টায় রাঙ্গামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে পিসিজেএসএস’এর কেন্দ্রীয় সদস্য সৌখিন চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঊষাতন তালুকদার। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আহ্বায়ক ও অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা, ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এ্যাডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, যুব সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানু মারমা ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা।

আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ দ্রুত চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান। এসময় নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘দীর্ঘ ২৩ বছরেও চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের বিপরীতে প্রতিনিয়ত চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ভূমি বেদখল, সাধারণ জুম্মদেরকে অস্ত্র গুজে দিয়ে গ্রেপ্তার, হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে।’

এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলায় চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা যায়। বাঘাইছড়িতে পিসিজেএসএস’এর বাঘাইছড়ি থানা কমিটির সভাপতি প্রভাত কুমার চাকমার সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিজেএসএস’এর রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সদস্য ডা: সুমতি রঞ্জন চাকমা এবং অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন থানা কমিটির সহ-সভাপতি উৎপলাক্ষ চাকমা, জ্ঞান প্রকাশ চাকমা, মহিলা সমিতির বাঘাইছড়ি থানা শাখার সভাপতি লক্ষীমালা চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিজেএসএস’এর থানা কমিটির সদস্য সচিব নয়ন জ্যোতি চাকমা। অপরদিকে পরিস্থিতির কারণে জুরাছড়ি উপজেলা সদরে কোন অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হলেও জুরাছড়ি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটির উদ্যোগে মৈদুং ইউনিয়ন এলাকায় কয়েকশ জনগণের অংশগ্রহণে এক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। এতে বিভিন্ন ইউনিয়নের জুম্ম সাধারণ গ্রামবাসীসহ কার্বারি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিন হন।

আঞ্চলিক পরিষদের উদ্যোগে আলোচনা সভা

চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ বেলা ২:৩০ টার দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ মিলনায়তনে আঞ্চলিক পরিষদের উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আঞ্চলিক পরিষদের অন্যতম সদস্য গৌতম কুমার চাকমা। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নির্মল কান্তি চাকমা।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।’ বক্তারা আরও বলেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদের বিধিমালা প্রণীত না হওয়ার কারণে সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না।’

চট্টগ্রাম:

দেশে অশুভ সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে, স্বাধীনতা বিরোধী ও পার্বত্য চুক্তিবিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে-এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত

চুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ বিকাল ৩:০০ টায় চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘বাংলাদেশে কেউ কেউ রাজনীতিকে সঙ্গী করে নানান ছলনায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন ‘বর্তমানে বাংলাদেশে অদৃশ্য অশুভ সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং স্বাধীনতা বিরোধী ও পার্বত্য চুক্তি বিরোধীরা প্রতিনিয়ত সক্রিয় হয়ে উঠছে।’

‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুন’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি, চট্টগ্রাম এর উদ্যোগে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক তাপস হোড় এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক হোসাইন কবির, কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা উত্তম চৌধুরী, চট্টগ্রাম ঐক্য ন্যাপের নেতা পাহাড়ী ভট্টাচার্য, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা শরিফ সোহান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সুমী খান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার নেতা এ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কক্সবাজার জেলা শাখার নেতা প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছাত্রনেতা নিপন ত্রিপুরা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির সহ-সভাপতি জুলিয়াস সিজার ত্রিপুরা এবং সভায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন অনিল বিকাশ চাকমা।

প্রধান অতিথি রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রশাসনে পাকিস্তানি প্রেতাত্মা আছে, খন্দকার মোস্তাক আছে, নিপীড়ন আছে। এদেরকে দ্রæত উৎখাত করতে না পারলে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে।’
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন বাস্তবায়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট নিরসনে এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারকে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানান।

আদিবাসী তরুণদের উদ্দেশ্য তিনি আরও বলেন, ‘হতাশার মধ্য দিয়ে মুক্তি মিলবে না। লড়াকু হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আগামীর সংগ্রামে শরীক হয়ে জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে আত্মবলিদানে প্রস্তুত থাকতে হবে।’
অধ্যাপক হোসাইন কবির তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের জননীতির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ক্ষতিক্ষারক অবদান রেখেছেন। বর্তমান জননীতির কারণে পাহাড়ি আদিবাসীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘রাষ্ট্র আজ অপশক্তির কাছে আপোষ করছে বলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি হচ্ছে।’

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে কবি হাফিজ রশিদ খান বলেন, ‘পাহাড়িদের জীবন আজ বিপন্ন। তারা চিৎকার করতে পারছে না। তারা আজ নিরুপায়।’ তিনি আরও বলেন, চুক্তির সুচিন্তিত বিষয়কে অবহেলা অবজ্ঞা করা হচ্ছে। যার ফলে সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এজন্য মুষ্টিমেয় আমলা তথা নেতার কাছে সরকার ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে।’

কমরেড উত্তম চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা সুখে নেই। তারা প্রতিনিয়ত নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। রাষ্টযন্ত্রের একটি মহল কর্তৃক অধিকার হরণ করা হচ্ছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের একঘরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

ঐক্য ন্যাপের নেতা পাহাড়ী ভট্টাচার্য বলেন, ‘পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কর্তৃক জুম্ম জনগণের সাথে ২৬ বার ধারাবাহিক আলোচনা করে ৫ দফা দাবির ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং তারা পর্যায়ক্রমে চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে তারা অনেকদূর এগিয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।’

অধ্যাপক প্রিয়তোষ শর্মা চন্দন বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের আজকের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে।’ তিনি চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন তথা নিপীড়িত মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানান।

কমরেড শরিফ সোহান বলেন, ‘বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদিবাসীরা অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আদিবাসীরা তাদের ভূমির জন্য, অস্তিত্বের জন্য লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ জুম্ম জনগণের পাশে আগে থেকেই আছে। কিন্তু বিশেষ একটি মহল পাহাড়িদের অধিকার নিশ্চিতে সদিচ্ছা প্রকাশ করছে না।’

বিশিষ্ট সাংবাদিক সুমী খান দুঃখ করে বলেন, ‘স্বাধীন দেশে বসবাস করেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি অধিকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।’ তিনি নিজের দায়বদ্ধতা থেকে সরকারকে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান এবং সকলের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান।

এ্যাডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ২৩ বছর পরেও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এখনো পর্যন্ত আন্দোলন করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের কোন সদিচ্ছা না থাকার কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বরং সরকার পার্বত্য চুক্তি কিভাবে বাতিল করা যায় তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত চুক্তি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।’ তিনি সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানান।

ছাত্রনেতা নিপন ত্রিপুরা বলেন, ‘নানান সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি পালিত হচ্ছে। সরকার পার্বত্য চুক্তি করেও ২৩ বছর পরেও তা বাস্তবায়ন না করে জুম্ম জনগণের সাথে প্রতারণা করেছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার একদিকে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কথা বলছে অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পাহাড়ে সেনাশাসন, ভূমি দখল চলমান রেখেছে।’ চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে তথা মানবাধিকার লংঘন প্রতিনিয়ত করতে থাকলে জুম্ম জনগণ বিকল্প পথ বেছে নেবে বলে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণ শিল্পীদের অংশগ্রহণে গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।

রাজশাহী:

চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তিতে আজ রাজশাহীতে আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং সমতলের আদিবাসীদের পৃথক স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের দাবি’তে এক মানববন্ধন আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১১:০০ টায় রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্টে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নকুল পাহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনের আলোচনায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক গনেশ মার্ডি, দপ্তর সম্পাদক সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম, রাজশাহী মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আন্দ্রিয়াস বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় সদস্য বিভূতি ভূষণ মাহাতো, আদিবাসী যুব পরিষদ রাজশাহী জেলার সভাপতি উপেন রবিদাস, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণ মুন্ডা, সহ-সাধারণ সম্পাদক আপেল মুন্ডা, সদস্য মলি বিশ্বাস প্রমুখ।

এছাড়া সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, রাজশাহীর বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশান্ত কুমার সাহা, ন্যাপ রাজশাহী জেলার সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, ৭১র ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রাজশাহী জেলার সভাপতি শাহাজাহান আলী বরজাহান, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বাস্তবায়ন মঞ্চ রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসে নি। এই চুক্তির প্রধান যে ধারাগুলো আদিবাসীদের জীবন এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িত সেই ধারাগুলো এখনো অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। যে কারণে আজকে পাহাড়ের আদিবাসীরা তাদের জমি হারাচ্ছে। চিম্বুক পাহাড়ে আদিবাসীদের জমিতে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের জন্য আদিবাসীদের জীবন বিপন্নকারী ঘটনা ঘটছে।’

মানববন্ধনে এইসব ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দা জানানো হয়। একই সাথে দেশের সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর চলমান ভূমিকেন্দ্রিক অত্যাচার, হত্যা এবং নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ জানানো হয়। সাথে সমতল আদিবাসীদের দীর্ঘ দিনের দাবি পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়।