পার্বত্য চুক্তির দুই যুগপূর্তি: স্বপ্ন ভঙ্গের পরিণাম কেমন হবে?

0
755

বাচ্চু চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বয়স এবারে দুই যুগে পা দিয়েছে। এক এক করে দীর্ঘ ২৪টি বছর চুক্তির মৌলিক বিষয় বাস্তবায়ন ছাড়াই জুম্ম জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে গেলো। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, কিন্তু “চুক্তি স্বাক্ষর করার চাইতে চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করা আরও বেশি কঠিন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করতে যতই না রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে তার চেয়েও অধিক চুক্তি বাস্তবায়নের জন্যে রক্ত ঢেলে দিতে হবে” – প্রিয়নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এই কথাটি সময়ের দাবিতে আজ বৈজ্ঞানিক সত্যে পরিণত হয়েছে।

শাসকগোষ্ঠী পাহাড়ের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সাথে চরমভাবে প্রতারণা করেছে, বেঈমানী করে চলেছে প্রতি পদে পদে, জুম্ম জনগণের সাথে মিথ্যাচার করে চলেছে বারবার এবং জুম্ম জনগণ তথা দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধাদের আস্থা ও বিশ্বাসের উপর চরমভাবে আঘাত করেছে। শাসকগোষ্ঠীর ভাবনাতে হয়তো এমনই যে, যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত জুম্ম জনগণ তথা জনগণের বন্ধুরা শাসকগোষ্ঠীর তীব্রতর আঘাত সহ্য করতে পারবে না। কিন্তু অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী জানে না মুক্তিকামী বিপ্লবীদের মন ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্যের চেতনায় সুসজ্জিত হয়ে থাকে এবং জুম্ম জনগণের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এই বিপ্লবীরা হল পোড়খাওয়া এক একটি লৌহমানব। সুতরাং শাসকগোষ্ঠীর প্রতারণায় জুম্ম জনগণ কখনো হতাশায় নিমজ্জিত হবে না, শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র হতাশা ও ঘৃণাকে সঙ্গী করে আবারও পাহাড়ের বুকে দিগন্ত জুড়ে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছাড়বে তারা।

শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে হয়তোবা স্থায়ী শান্তির বাতাবরণ নেই, নেই চুক্তি বাস্তবায়নের কোন প্রকার সদিচ্ছা, নেই কোন জুম্ম জনগণের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস, হারিয়ে গেছে জুম্ম জনগণের প্রতি ভালবাসা, তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ এখনও হতাশ নয়, তারা এখনও আশাবাদী। পাহাড়ের জুম্ম জনগণ তথা জুম্ম জনগণের কাছের বন্ধু গেরিলা যুদ্ধারা এখনও স্বপ্ন দেখে, এবং স্বপ্ন বুনে চলেছে সারাক্ষণ। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এখনও লড়ে যাচ্ছে বয়সের অন্তিম সময়ে।

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিজ বাড়িতে প্রত্যার্বতন করেছিলেন তারা। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর প্রতারণা ও বেঈমানের কারণে স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্ন আজ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। তারপরও বর্তমান জুম্ম তরুণ প্রজন্মকে সেই মহান বিপ্লবীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এবং বছরের পর বছর ধরে। শাসকগোষ্ঠীর কাছে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের জন্যে শান্তি, বিশ্বাস ও ভালবাসা না থাকতে পারে, কিন্তু জুম্ম জনগণের কাছে শেষ সম্বল হল আশা। এই আশা নামক বস্তুটি নিপীড়িত জুম্ম জনগণ তথা জনগণের কাছের বন্ধু গেরিলাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। এই আশা নামক বস্তুটিই জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে ৭০/৮০ দশকে পাহাড়ের সশস্ত্র গেরিলাযোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিলো পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে, চুক্তির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর দীর্ঘ দুই যুগ পেরিয়ে গেল, কিন্তু এখনও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। এসব পরিষদের নিকট এখনো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয়নি। অন্যদিকে নির্বাচন ছাড়া সরকার দলীয় দালাল ও কুলাঙ্গারদের বসিয়ে অন্তর্বর্ন্তী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো আজ লুটেপুটে খাচ্ছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে সরকার দলের পছন্দের ব্যক্তিরা আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। নির্বাচিত কোন জনপ্রতিনিধি পরিষদে না থাকাতে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আজ জেরো-টোলারেন্টে নেমে এসেছে। সরকার দলের লুটপাটের কারখানা তথা অনিয়ম ও দূর্নীতির আখড়াই পরিণত হয়েছে জেলা পরিষদগুলো। এভাবেই আজ জুম্ম জনগণ তথা দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র গেরিলাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে সরকার। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের স্বপ্ন ভঙ্গের পরিণাম কতটা ভয়াবহ হবে আগামী দিনই তা বলে দেবে। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুম্ম জনগণের নিকট এক ধরণের না পাওয়ার বেদনা ও যন্ত্রণার বোধ জেগেছে, এরই উপর ভিত্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আবারও অশনিসংকেত যেন দেখা দিচ্ছে, এবং চূড়ান্তভাবে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী থাকবে কেবল সরকার।

উল্লেখ্য যে, ২৪ বছর আগে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান হয়েছিল। জুম্ম সমাজের মধ্যে চুক্তির প্রথম দিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয়, দিন যতই গড়িয়েছে আশা-নিরাশার এক দোদুল্যমানতার মধ্যে দুলেছে জুম্ম জনগণের ভাগ্য। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে সাধারণ প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা, উন্নয়ন, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো ন্যস্ত করা, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জন্য টাস্কফোর্স গঠন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ জুম্ম জনগণের মনে সুন্দর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতির ডাক দিয়েছে, অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী দুই পক্ষের পরস্পরের প্রতি আস্থার অভাব, সন্দেহ ও অবিশ্বাস ইত্যাদি প্রবলভাবে দানা বাঁধার কারণে জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে তীব্র হতাশার সৃষ্টি করেছে। দুই যুগের অধিক অস্ত্র, রক্ত ও অশ্রুর দিনগুলো পেরিয়ে এসে যখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল পাহাড়ের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ, তখন ২৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় চলমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতা ইউটানের সম্ভাবনায় আবারও ভীতিকর অতীতকে ফিরিয়ে আনছে জুম্ম জনগণের সামনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্য, পাহাড়, জুমে-জুমে এবং লোকালয়ে আজ ধ্বনিত হচ্ছে একটাই “নিপীড়িত জুম্ম জনগণের স্বপ্ন ভঙ্গের পরিণাম কেমন হবে”? এই প্রশ্নের মীমাংসা কেবল সময়ের দাবী!

আজও স্মৃতির মানস পথে ভেসে ভেসে ওঠে, দুর্গম পাহাড়-অরণ্যের অন্ধকারে কেটেছে ৭০/৮০ দশকের গেরিলাদের তারুণ্যের দিনগুলো। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন এমনিতেই কেটেছে তাদের শ্রেষ্ঠ সময়। যে সময়টাতে মা বাবার স্নেহ, ভালবাসা পেয়ে একসাথে বাড়িতে থাকবার কথা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে আনন্দ-উল্লাস করবার কথা, প্রিয়জনের সাথে কাছাকাছি থেকে জীবনকে সাজানোর কথা, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্মম বাস্তবতা ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিই বিশেষ করে ৮০ দশকের জুম্ম তরুণদের এসকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিলো। অথচ তাদের স্বপ্ন ছিলো আকাশ ছোঁয়া, সেই স্বপ্নকে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের কাছে উপস্থিত করে অধিকারের জন্য দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র গেরিলা কায়দায় লড়েছিল তারা। চোখের সামনে নিজের অনেক ভালবাসা ও ভাললাগার সহযোদ্ধাকে হারিয়েছে, অনেক গেরিলা তার প্রিয় মা-বাবা, প্রিয় আজু-নানুর মৃত্যুর পর শেষ দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত পায়নি। এমনই দুঃসহ স্মৃতিকে বুকে নিয়ে দুই যুগের অধিক সময় কাটিয়েছে জঙ্গলে।

আজ হতে ২৪ বছর আগে অস্ত্র সমর্পণ করে তারা ফিরে এসেছিলেন স্বাভাবিক জীবনে। তাদের মধ্যে খুব বেশি চাওয়া-পাওয়াও ছিলো নেই। আজ জানতে ইচ্ছে করে, ২৪ বছর আগে যে স্বপ্ন নিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন, সেই স্বপ্ন কতটা পূর্ণ হয়েছে? অথচ বাংলাদেশ সরকারের উপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে তারা অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন, সরকারের উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন বলে চুক্তির সময় তৃতীয় কোন পক্ষও উপস্থিতি রাখার প্রয়োজনবোধ করেননি। গেরিলা বন্ধুদের তথা জুম্ম জনগণের বিশ্বাসের উপর শাসকগোষ্ঠী আজ ছুরিকাঘাত করেছে, ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের মনে দিন দিন শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র হতাশা, ঘৃণা ও ক্ষোভের আগুন জন্ম হচ্ছে। এই আগুন বিস্ফোরণ হলে কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম পুড়বে না, পুড়বে গোটা বাংলাদেশ।

কত বর্ষা, শীত ও বসন্ত গেরিলাদের জীবনে এলো আর গেলো সেই হিসাব তারা রাখেনি, তাদের হিসাব কেবল নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তি, অত্যাচারী স্বৈরশাসকের অমানবিক শোষণ, বঞ্চনা থেকে জুম্ম জাতিকে মুক্ত করা। মানবতাই তাদের চলার পথে একমাত্র আদর্শ ছিলো, যে আদর্শ মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ না করে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে, জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ করে না, নারী আর পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করে না, ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ ও বৈষম্য করে না, এধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করা, বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও বঞ্চনার নির্মম বাস্তবতা থেকে জুম্ম জাতিকে মুক্ত করা, নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে জুম্ম জাতীয়তাবাদকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন তারা, যুগ যুগ ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস করা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী জুম্ম জাতি সমূহের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে জুম্ম জাতীয়তাবাদকে জুম্ম জনগণের মধ্যে লড়াই সংগ্রামের ঐক্য চেতনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন এই গেরিলাযোদ্ধারা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও জুম্ম সমাজে সমঅধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছেন, যাতে করে নারী পুরুষের সমান অধিকার, সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে ন্যায়কে মূলনীতি ধরে নিয়ে তারা জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পাহাড়ের বুকে অগণতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বের অবসান করা এবং ইসলামি ধর্মান্ধতার ধারক-বাহক বাংলাদেশ সরকার তথা উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ইসলামি সম্প্রসারণবাদের বিরোধীতা ও প্রতিরোধ করতে তারা সবসময় সোচ্চার ছিলেন। সুনির্দিষ্ট কোন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জুম্ম জনগণের ও নিজস্ব দলের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য জীবন উৎসর্গের বলিষ্ঠ প্রত্যয় ছিল তাদের হৃদয়ের অন্তরালে, যে চেতনা মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ তাঁর সহযোদ্ধা বা আমাদের প্রিয় অগ্রজদের শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে তোলা জুম্ম জনগণের প্রাণের সংগঠন জনসংহতি সমিতির হতে প্রাপ্ত।

নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পার্টির সদস্যদের মান-সম্মান ও জীবন রক্ষার শপথ নিয়ে তারা লড়াই সংগ্রামে দীর্ঘযাত্রায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ সময় পার করেছিলেন, তাদের কথা ও কাজে আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টার কোন কমতি ছিলো না। জুম্ম জাতির দুঃসহ বেদনা ও যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে কখনো ক্লান্তি অনুভব করেননি তারা, হাজারো কষ্টের পরেও নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাণপণ জনগণের সেবা করতে চেয়েছিলেন। এভাবেই ৭০/৮০ দশকে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে জাতির উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিলেন জুম্ম জনগণের সবচেয়ে কাছের আপনজন গেরিলা বন্ধুরা।

চুক্তির সময় নিপীড়িত জুম্ম জনগণ তথা জুম্ম জনগণের কাছের জন সশস্ত্র গেরিলা বন্ধুরা আশা করেছিলেন, পাহাড়ের বুকে ভূমি ও স্বজন হারানোর চাপা গোঙানির আত্মচিৎকার আর কান্নার আহাজারি চিরতরে অবসান হবে। এই জুম পাহাড়ে জুম্মরা নিরাপদে-নিচিন্তে ঘুরে বেড়াবে, আমাদের জীবন আমাদের মতোই হবে। সুন্দর সমাজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে, হয়নি। অথচ এই চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ হাজারো গেরিলা যুদ্ধার অমানুষিক শ্রম, ত্যাগ ও রক্ত জড়িয়ে আছে। শত হাজারো শিক্ষিত জুম্ম তরুণ বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মহান স্বপ্ন ও আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন এবং নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির আন্দোলনে জনগণের সম্মতি, সমর্থন, সহযোগিতা ও আন্তরিকতা আদায়ের লক্ষ্যে মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে সংঘবদ্ধ একঝাঁক জুম্ম তারুণ্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেদিন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে গ্রামাঞ্চলের অন্ধকারাচ্ছন্ন সামন্তীয় সমাজের অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা নিপীড়িত-বঞ্চিত, গরীব-দুঃখী মানুষের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন গেরিলারা। প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শ হতে প্রাপ্ত তারুণ্যের নবলদ্ধ জ্ঞান প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন পাহাড়ের দিক হতে দিগন্তে, অপেক্ষাকৃত প্রাচূর্যময় সমাজের মানুষের জীবন গড়ে তোলার জন্য জুম্ম জনগণের কাছে সংগ্রামের মশাল জ্বালিয়ে ছিলেন। বর্তমান জুম্ম তরুণরা যেন হতে পারে সেই পথের পথিক, এবং প্রিয় অগ্রজ সংগ্রামী গেরিলাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যেন পাহাড়ের বর্তমান জুম্ম তরুণরা লড়াইকে ধরে রাখতে পারে যুগের পর যুগ ধরে-প্রত্যাশা কেবল আমার একার নই, সমগ্র জুম্ম জনগণেরই।

আজ অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ৮০ দশকের জুম্ম তরুণরা পেয়েছিলেন প্রগতিশীল আদর্শ প্রচারের একটি শক্তিশালীধারা, এবং কাজের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ জুম্ম জনগণের সামনে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিলেন-রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সম্পর্কের নতুন নতুন ধারণা। সেই সময় তারুণ্যের মনে এক ধরণের অদ্ভূত অনুভূতি কাজ করেছিল, গেরিলারা নিজেদেরকে মনে করেছিলেন যেন তীব্র জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত একদল তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে বসবাস করছে। সেই তারুণ্যের মধ্যে সেদিন মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন ছিলো। সাত সাগর তের নদী পাড়ি দেওয়ার মতো সাহস, শক্তি ও দৃঢ় মনোবল ছিলো। এখানে সবচেয়ে স্মরণযোগ্য যে, ইতিহাসের বিচিত্র ছকের ফলে ক্রিকেট খেলা ও ফুটবল খেলা, প্রেম-ভালবাসা, অপ্রয়োজনীয় আড্ডার আসর প্রভৃতি যা অন্য দেশের তারুণ্যের কাছে প্রধান আকর্ষণ হলেও তার চেয়ে সংগ্রামী জীবনই যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের সেদিনের তারুণ্যের ভরা গেরিলাদের কাছে বেশি জরুরি মনে হয়েছিলো।

পরিস্থিতি ও বাস্তবতা তাই দাবি করেছিলেন, এবং চুক্তির দুই যুগের পর আজকের দিনে পুরানো দিনের স্লোগান ও দাবিদাওয়া পাহাড়ের চারিদিকে আরও নতুন করে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তবে মনে রাখবেন, তরুণ সমাজ বিপুল সমাবেশ ছাড়া জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাইতো বারেবারে স্মরণ করিয়ে দিতে আমি ক্লান্ত হয় না এবং সময়ের দাবিও তাই, জুম্ম তরুণদের হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যের প্রাচুর্যও তো বয়ে নিয়ে যেতে হবে জুম্ম জনগণের সামনে। অতীতের দৃষ্টান্ত ও জুম্ম জাতির ইতিহাসের কিংবদন্তি গেরিলাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে আমাদের সকলেরই।

দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অবসানের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে মন খুলে যুদ্ধ জয়ের গল্প, জীবনের গল্প ও পাহাড়-অরণ্যে প্রচন্ড রোদ, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে এবং শীতের সকালে প্রচুর ঠান্ডার মধ্যে তারুণ্যের সময় কাটানোর গল্প বলার পরিবেশ আজও পায়নি। একটা আদর্শকে সামনে রেখে তারা যুদ্ধ করেছিলেন, গেরিলাদের মুখে মুখে শুনা যায় একটা কথা-এক বাঘে হাজার হাজার হরিণ তাড়াতে পারে! সুতরাং গেরিলারা এক একটা বাঘের সমান, একজন গেরিলাযোদ্ধা হাজার, লক্ষ নিপীড়িত মানুষের আশা, আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারে। পাহাড়ের শান্তিবাহিনীর নামে গেরিলাদের জীবন এমনটাই ছিলো, এবং বিশ্বের বুকে দ্বিতীয় গেরিলা হিসেবে শান্তিবাহিনীর নাম প্রসিদ্ধ ছিলো। ৮০ দশকের জুম্ম তরুণ গেরিলারা জুম্ম জাতির দুরবস্থা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপন্ন মানবতা নিজের দুচোখে প্রত্যক্ষ করে দেশপ্রেমের প্রবল প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।

সেই ৮০ দশকের জুম্ম তরুণরা আজ ৫০/৬০ বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণ হয়েছে, টগবগিয়ে চলনবলন আজ আগের মতন নেই! তারপরও জুম্ম জাতির অধিকারের বিষয়ে আজও তারা সদা সর্বদাই সচেতন, জুম্ম জাতির হারানোর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়ার প্রচেষ্টার কোনকালেই কমতি ছিলো না। তারুণ্যের টগবগের শ্রেষ্ঠ সময়ে তারা পাহাড়ের নিপীড়িত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মনে আশা ও বিশ্বাসের চারা রোপণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের সামনে সবকিছুই ছিল, আবার কিছুই ছিল না, সেদিন তারা সোজা সমাজের স্রোতের বিপরীতে হেঁটেছিলেন এবং সেই উল্টোদিকে হাঁটতে গিয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেই জুম্ম তারুণ্যের সামনে ছিল বিশাল এক স্বপ্ন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে তারা বেছে নিয়েছিলেন প্রয়াতনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত আদর্শের মোড়ানো লৌহইস্পাত কঠিন পথ। ৮০ এর দশকে জুম্ম তারুণ্য যখন আন্দোলন সংগ্রামের চরম উত্তেজনায় ভরপুর, তখন আশা-নিরাশায় দুলছে পুরো জুম্ম জাতি তথা নিপীড়িত ও শোষিত মানুষ, এমনতরো পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার তথা দমন-পীড়নের বাস্তবতাকে কবর দিয়ে নতুন যুগের অভ্যুদয়ের আকাঙ্খায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একঝাঁক সংঘবদ্ধ জুম্ম তরুণ।

শাসকগোষ্ঠীর মধ্যযুগীয় বর্বরতা, স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক কায়দায় জুম্ম জাতিকে শোষণ, নিপীড়নের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম তারুণ্যের মনে জন্মেছিলো আন্দোলন সংগ্রামের ইস্পাত-দৃঢ় মহান চেতনা। ৮০ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে শাসকগোষ্ঠী অর্থনৈতিক সমস্যা আখ্যায়িত করে সামরিক উপায়ে সমাধানের চেষ্টা কিছুদিনের মধ্যেই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। এই ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪ বছর পর মৌলিক কোন বিষয় যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় স্বপ্ন ভঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।