পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ বাতিলের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি

হিল ভয়েস, ১৮ জুলাই ২০২৪, রাঙ্গামাটি: আজ (১৮ জুলাই) সকালের দিকে রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা এর উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ বাতিল করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক মানববন্ধন আয়োজন ও প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রেরণ করা হয়েছে।

ব্যানারে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকার সম্বলিত আইনে প্রতিষ্ঠিত শত শত বছরের প্রথা ও রীতিনীতির কার্যকারিতা নস্যাৎ করার চলমান ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করা হয়।

মানববন্ধনে রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন। মানববন্ধনের এক পর্যায়ে ভিক্ষুদের একটি প্রতিনিধিদল রাঙ্গামাটি ডেপুটি কমিশনারের নিকট প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে লিখিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, “..আমরা পার্বত্য অঞ্চলের সর্বসাধারণের মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ নিয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা লক্ষ্য করছি। তাদের উদ্বেগ ও আশঙ্কার সাথে একাত্ম হয়ে আমরাও পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে উক্ত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’-কে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করবার লক্ষে এ স্মারকলিপি প্রেরণ করছি।”

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এতে আরও বলা হয়, “আপনি অবগত আছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন সংক্রান্ত প্রধান আইনী দলিল। এটি ১৯ জানুয়ারি ১৯০০ সালে কার্যকর করা হয় এবং সেই সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এটি বৈধ আইন হিসেবে কার্যকর রয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রথাগত শাসনব্যবস্থা, সামাজিক বিচার পদ্ধতি, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং এই অঞ্চলের পাহাড়ি আদিবাসী জনগণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। ১২৫ বছর ধরে চলে আসা এই আইনকে এখন রীতি বহির্ভূতভাবে ছেঁটে ফেলার অপচেষ্টা চলছে।”

 

এতে উল্লেখ করা হয়, “২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এ এফ হাসান আরিফের আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টের একটি বিভাগীয় বেঞ্চ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’-কে একটি ‘মৃত আইন’ হিসেবে ঘোষণা করেন (Rangamati Food Products v. Commissioner of Customs & others, 10 BLC(2005), 525)। হাইকোর্টের এমন ঘোষণা বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়নি বলে পরবর্তীতে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে আপাীল করা হয়। ২০১৭ সালে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ শুনানি শেষে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশ ১৯০০’-কে একটি সম্পূর্ণ ‘জীবিত ও বৈধ’ আইন হিসেবে বলবৎ রাখেন। [Wagachara Tea Estate Ltd v. Muhammad Abu Taher & Others, 16 BLD(AD)(2026),36]।

কিন্তু ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ি জেলার জনাব আবদুল আজিজ আখন্দ এবং জনাব আব্দুর মালেক নামে দুজন বসতিস্থাপনকারী ব্যক্তি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ বিষয়ক সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে দুটি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন (যার সিভিল পিটিশন নম্বর যথাক্রমে ৫৪/২০১৮ এবং ১৯২/২০১৮)। তাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এ এফ হাসান আরিফ। উল্লেখ্য, রিভিউ পিটিশনকারী ব্যক্তিদ্বয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’ সংক্রান্ত উল্লিখিত মামলা সমূহে কোনো পক্ষভুক্ত ছিলেন না।”

এতে আর ওবলা হয়, “আমরা মনেকরি, প্রচলিত সাধারণ রীতি অনুসারে সরকারের আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলের সরকারের অনুকূলে সুপ্রীম কোর্টের দেওয়া উক্ত রায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার কথা। জানা গেছে, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল তা না করে অযাচিতভাবে রিভিশনের নামে কিছু শব্দ যেমন ‘Raja’, ‘Indigenous’-সহ পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রথাগত আইনের (Customary Law) বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত সর্বমোট ১০টির অধিক অনুচ্ছেদ আপীল বিভাগের দেওয়া রায় থেকে বাদ দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে মৌখিক ও লিখিত প্রার্থনা করেছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের এ ধরনের উদ্যোগের ফলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০’-কে বাতিল করা হলে পাহাড়ি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার খর্ব হওয়া সহ প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হবে। পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে যে শান্তি ও আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেটা বিনষ্ট হওয়া সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।”

স্মারকলিপিতে অ্যাটর্নি জেনারেল যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-এর ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের ইতোপূর্বে দেওয়া রায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন, তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

স্মারকলিপিতে শত বছর ধরে চলে আসা পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০-কে আদালতের কলমের খোঁচায় ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া প্রজ্ঞার পরিচয় হতে পারে না বলে উল্লেখ করা হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭-এর আলোকে পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান, প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও জনগণের পরামর্শক্রমে আইনের সুষমকরণ সহ এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

স্মারকলিপিতে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ-এর পক্ষে স্বাক্ষর করেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর সভাপতি শ্রদ্ধালংকার মহাথের, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর রাঙ্গামাটি সদর শাখার সভাপতি পূণ্যজ্যোতি মহাথের, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর বিলাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি আর্য্যলংকার মহাথের, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শীলপাল মহাথের, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর কাউখালী উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক গুণপ্রিয় থের, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর নানিয়ারচর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমনাপ্রিয় থের এবং পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ এর জুরাছড়ি ও বরকল উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মঙ্গলপ্রিয় থের।

More From Author

+ There are no comments

Add yours