পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত: নেতৃত্বে মনি চাকমা, আশিকা চাকমা ও সুবিনা চাকমা

হিল ভয়েস, ১০ অক্টোবর ২০২৫, রাঙ্গামাটি: আজ শুক্রবার (১০ অক্টোবর) “সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে ইস্পাত দৃঢ় জুম্ম জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি, জুম্ম জাতির অধিকারের সনদ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করি” এই আহ্বানে রাঙ্গামাটির আশিকা কনভেনশন হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’র ১৩তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে মনি চাকমাকে সভাপতি, আশিকা চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক, সুবিনা চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট ১৪তম কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করা হয়।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির প্রাক্তন সভাপতি মাধবীলতা চাকমা। এছাড়াও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক শ্যামা চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সদস্য আশিকা চাকমা।

সম্মেলনের শুরুতে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা আত্মবলীদান করেছেন তাদের স্মরণে ২ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সম্মেলনে বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সভাপতি রিতা চাকমা।

উদ্বোধক মাধবীলতা চাকমা বলেন, আজকের এই ক্ষণে ১৯৭৫ সালের ১১ জুন পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির প্রথম সম্মেলনের দিনগুলো মনে পড়ছে। সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী সমাজের প্রগতিশীল অংশ মহিলা সমিতির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সাহসিকতার সাথে সংগ্রামে যুক্ত হন। বর্তমানে মহিলা সমিতির সদস্য সংখ্যা কম হলেও যারা এখনো জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাই।

প্রধান অতিথি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, শাসকগোষ্ঠী দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা প্রদান করে পার্টিকে স্তব্দ করে দিতে চেয়েছিল। সে সময় মহিলা সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা কিছুটা ব্যহত হলেও থেমে থাকেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি সদস্যদেরকে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে তরুণদের বেশী এগিয়ে আসতে হবে। নবনির্বাচিত কমিটিতে অর্ধেকাংশ তরুণ অংশগ্রহণ করেছে যা আমাদের জন্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

তিনি আরো বলেন, নেতৃত্ব গঠনের জন্য আদর্শের আলোকে অধ্যয়ন করতে হবে। সমাজে নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণাবলী অর্জন করতে হবে। লড়াই সংগ্রাম করার জন্য অবশ্যই সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে উঠতে হবে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের অগ্রযাত্রাকে সীমিত করে রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম নারীরা প্রায়ই শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ন নিষ্পেষনের শিকার হয়ে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ ছাত্রী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন, উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভ করছেন। কিন্তু সমাজে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে তাদের যথাযথ অনুধাবন দেখা যায় না। বরং অনেকাংশকে আত্মমূখিতায় জর্জরিত চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই।

তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে বলেন, জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে বৃহত্তর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে তরুণ ছাত্র-যুব সমাজ, নারী সমাজ তথা সকলকে অধিকতরভাবে সামিল হতে হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নানা ধরণের সুবিধাবাদীতা, পশ্চাৎপদ চিন্তা ঝেঁকে বসেছে। সেসব কিছুকে পেছনে ফেলে বৃহত্তর আন্দোলনকে সুসংগঠিত হতে হবে। জুম্ম নারীদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে এবং নারী সমাজকে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল করতে হবে।

ঊষাতন তালুকদার বলেন, জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, নারীদের নিরাপত্তা বিপন্ন। নারীরা সমাজের অর্ধেক অংশ, এই অর্ধেক অংশকে পেছনে রেখে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নারী সমাজের ভূমিকা রাখতে হবে, না হলে আন্দোলন সফল হবে না। আমরা কেন লড়াই করছি, কি লক্ষ্যে লড়াই করছি তা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে হবে। বিজাতীয় শাসন শোষনের অবসানকল্পে নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে সামিল হতে হবে। নারীদের সমাজে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নারী সমাজকে সংগঠিত হতে হবে।

তিনি আরো বলেন, শাসকগোষ্ঠী অবস্থা কি তা বুঝে আমাদের আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ জুম্ম জনগণকে বিভ্রান্ত করে শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় জুম্ম জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে। জুম্মরা অতীতেও প্রমাণ দিয়েছে যে অধিকারের জন্য কঠিন সংগ্রাম করে সক্ষম। আমাদেরকে আবারো জুম্ম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশের অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের বিরুদ্ধে নানা কল্পকাহিনী বানিয়ে, নানা ধরনের মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে, বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্যাগ দিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।

সভাপতির বক্তব্যে শ্যামা চাকমা বলেন, আমাদের নারী সমাজের মুক্তি, সমাজে নারীদের সমসমর্যাদা, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে। সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল, আবারো বৃহত্তর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা হবে। গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, থানা থেকে জেলা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জাতীয় ইস্পাত কঠিন সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে মহান পার্টির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে মনি চাকমাকে সভাপতি, আশিকা চাকমাকে সাধারণ সম্পাদক, সুবিনা চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির প্রস্তাবিত ১৪তম কেন্দ্রীয় কমিটি উপস্থাপন করা হয় এবং প্রতিনিধিদের মুহুর্মুহু করতালির মধ্য দিয়ে কমিটি নির্বাচিত হয়। নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ সভাপতি ঊষাতন তালুকদার।

More From Author

+ There are no comments

Add yours