পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা স্থগিত করায় ৩৩ জন নাগরিকের উদ্বেগ

হিল ভয়েস, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ঢাকা: মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক অধিকার কর্মীসহ দেশের ৩৩ জন নাগরিক “রাঙামাটি সচেতন নাগরিক সমাজ” এর নাশকতার হুমকিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের ১৯ অক্টোবর ২০২৫ তারিখ অনুষ্ঠেয় সভা স্থগিত করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

আজ সোমবার (২০ অক্টোবর) এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা গভীর ক্ষোভ, উদ্বেগ ও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি, পার্বত্য তিন জেলায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হলেও গত ২৪ বছরে এ কমিশন বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেনি। তবে ২০১৬ সালে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন সংশোধনের পর ভূমি কমিশনের কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ছাব্বিশ হাজারের অধিক ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন জমা পড়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু এই বিরোধীয় বিষয়গুলি নিষ্পত্তির জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর করতে একান্ত প্রয়োজনীয় কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, এমনকি কমিশন পরিচালনার জন্য যথাযথ লোকবল এবং প্রয়োজনীয় বাজেটসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। এর আগের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানগণও এই সভা করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজও সকল পরিস্থিতি জানার পরও তথাকথিত নাগরিক পরিষদ ও তার ক্ষমতার পেছনের স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের হাতে জিম্মি হয়ে একই পথে চলে সভা অনুষ্ঠান না করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এখানে লক্ষনীয় সরকারের ভেতরের একটি প্রভাবশালী মহল প্রচ্ছন্নভাবে, কখনো কখনো প্রকাশ্যে এই চুক্তি বিরোধীদের সহিংস ও ধংসাত্মক তৎপরতায় ইন্ধন যুগিয়ে আসছে বলে অনেক দিন থেকেই অভিযোগ রয়েছে। তাদেরই মদদে এই কথিত নাগরিক পরিষদ সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা বাতিলের জন্য রাঙামাটি সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে অবরোধের হুমকি দিয়েছে। আর এই অছিলায় ১৯ অক্টোবরের পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের পূর্ব নির্ধারিত সভা স্থগিত করা হয়েছে। আমরা চুক্তি বিরোধী তথাকথিত নাগরিক পরিষদের নাশকতাপূর্ণ তৎপরতা এবং ভূমি কমিশনের সভা স্থগিত করার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশাসনের আইন-শৃংখলা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের চুক্তি বিরোধীদের ব্যাপারে নমনীয় এবং দৃশ্যত ও বাস্তবে সহায়ক ভূমিকার কঠোর প্রতিবাদ জানাই।

ভূমি বিরোধের জেরে একের পর এক পাহাড়ি গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা, বাড়িঘরে অগ্মিসংযোগ, লুটপাট, পাহাড়ি নারীদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণসহ পাহাড়িদের হত্যা, অপহরণ, মিথ্যা মামলা, হয়রানি ক্রমেই এই জনপদকে নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। দেশের অন্যান্য যেকোনো অংশের চাইতে নিরাপত্তার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক সেনানিবাস ও দু’শতাধিক সেনা ক্যাম্প স্থাপন করার পরেও এই অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কার মাত্রা দিন দিন শুধু বৃদ্ধিই পাচ্ছে। এটি দিবালোকের মতো পরিস্কার যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমিবিরোধের স্থায়ী সমাধান না করে এবং অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত না করে দিনের পর দিন নিরাপত্তার চশমা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের বঞ্চনার সমস্যাকে বার বার শুধু উপেক্ষা করে সেটলার অপাহাড়িদের মধ্যে কিছু লোককে বা একটি সহিংস গোষ্ঠীকে তাদের উপর হামলা নির্যাতন চালাতে উৎসাহ ও ইন্ধন দিয়ে এবং যে কোন ঘটনায় পাহাড়িদের উপরই দোষ চাপিয়ে গুলি, হত্যা, গ্রেফতারের নিপীড়নের শিকার বানিয়ে সমস্যাকেই কেবল জটিল করে তোলা হচ্ছে। আর স্থানীয় পাহাড়িসহ সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

আমরা তাই পার্বত্য তিন জেলায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের নির্ধারিত সভা অনুষ্ঠানে বার বার কারা বাধা দিচ্ছে, আর কেন একই অজুহাতে সভা স্থগিত করা হচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীন নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তার কারণ উদঘাটন করার জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে সরকারের ভেতরের কোন প্রভাবশালী মহলের এতে কোন ইন্ধন ছিল বা আছে কিনা তাও সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা এবং দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

মনে রাখা জরুরি যে, সরকার বা সরকারের কোন প্রভাবশালী মহলই শুধু পার্বত্যবাসী নয় সমগ্র দেশবাসীর কাছে তার যে কোন কাজ এবং অনভিপ্রেত আচরণের জবাবদিহির দায় কোন অজুহাতেই এড়াতে পারে না। ‘২৪- এর জুলাই অভুত্থান সেই বার্তাই সকলকে আর একবার দৃঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।”

বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন-
১. সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন
২. খুশী কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি
৩. ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআই-বি.
৪. শিরীন পারভীন হক, সদস্য, নারী পক্ষ
৫. শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
৬. শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি
৭. পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক
৮. সুব্রত চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
৯. এড. তবারক হোসেন, সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
১০. অ্যাডভোকেট তাসলিমা ইসলাম, প্রধান নির্বাহী, বেলা
১১. অ্যাডভোকেট সালমা আলী, নির্বাহী পরিচালক, বি এন ডব্লিউ এল এ
১২. তাসনীম সিরাজ মাহমুব, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৩. ড. জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৪. ড. খাইরুল চৌধুরী, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৫. ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৬. ড. ফেরদৌস আজীম, অধ্যাপক, ইংরেজি ও মানবিক বিভাগ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়
১৭. ড. মোশরেকা অদিতি হক, সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৮. ফারহা তানজীম তিতিল, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯. অ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
২০. জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ
২১. পল্লব চাকমা, নির্বাহী পরিচালক, কাপেং ফাউন্ডেশন
২২. রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট
২৩. মনিন্দ্র কুমার নাথ,ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ
২৪. সালেহ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন
২৫. অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, প্রধান নির্বাহী, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন
২৬. সাইফুর রহমান তপন, সাংবাদিক
২৭. মাহাবুবুল হক, মানবাধিকার কর্মী
২৮. শাহেদ কায়েস, কবি ও মানবাধিকার কর্মী
২৯. মেইনথিন প্রমীলা, কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
৩০. দীপায়ন খীসা, মানবাধিকার কর্মী
৩১. সাঈদ আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী
৩২. হানা শামস আহমেদ, গবেষক ও আদিবাসী অধিকার কর্মী
৩৩. মুক্তাশ্রী চাকমা, কোর গ্রুপ মেম্বার, সাঙ্গাত।

More From Author

+ There are no comments

Add yours