পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে র‍্যালি, গণসঙ্গীত ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

হিল ভয়েস, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫, চট্টগ্রাম: গতকাল মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) “জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সামিল হোন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করুন” এই আহ্বানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে চট্টগ্রামে র‍্যালি, গণসঙ্গীত ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামস্থ নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার চত্বরে গতকাল দুপুর ২:৩০ ঘটিকায় উদ্বোধনী পর্বের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এবং উদ্বোধনী পর্বের পরে র‍্যালি সহকারে এসে জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা শুরু হয়।

অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু মহোদয়। এছাড়াও আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক রণজিৎ কুমার দে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি শাহ আলম, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি প্রকৌশলী পরিমল কান্তি চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহিম, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য শরৎ জ্যোতি চাকমা, কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, ঐক্য ন্যাপ, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অজিত দাশ, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরী প্রমুখ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক তাপস হোড়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় সঞ্চালনা করেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল বিকাশ চাকমা এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব হ্লামিউ মারমা। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে সঞ্চালনা করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার স্কুল ও পাঠাগার সম্পাদক অপূর্ব চাকমা।

আলোচনা সভার শুরুতে গণসঙ্গীত ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।

উদ্বোধনী বক্তব্যে ড. জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, দেশের অভ্যন্তরে একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে কেন চুক্তিতে উপনীত হতে হবে যদি সরকার তাদেরকে নিজ নিজ নায্য অধিকার নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করার সুযোগ দেয়। সংখ্যালঘুরা যদি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্তিত্ব নিয়ে বসবাস করতে না পারি তাহলে যারা শান্তির স্লোগান দিচ্ছে তাদের কথার সাথে কাজের মিল আছে কিনা সন্দেহ আছে। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যাকে সমাধানের জন্য প্রধান সমস্যা ভূমি সমস্যার সমাধান করতে হবে। আপনারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছেন বিধায় ক্ষমতার জোরে আমাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। আজকে আমরা যে প্রতিবাদ মিছিলে নিজেদের একাত্ম করতে বাধ্য হয়েছি এগুলো আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয়। আপনারা আমাদের যে শান্তনার বাণী শুনান, আশার বাণী দেন কিন্তু বাস্তবে গেলে দেখা যায় আপনাদের সেই অন্তরের কুবুদ্ধিই আছে। আমরা সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী, দেশের সকল নাগরিক সমঅধিকার, সমবন্টন নিয়ে সহাবস্থান করতে চাই। আপনারা যদি সত্যি মানবিক, উদার হন তাহলে দেশের আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দিন।

আলোচনা সভায় অধ্যাপক রঞ্জিত কুমার দে বলেন, সরকারের ইচ্ছাতেই পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন সংগঠিত হচ্ছে। চুক্তি নিয়ে অবাঞ্চিত বক্তব্য যেকোন সরকার থেকে কাম্য নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরও নির্যাতন নিপীড়ন চলমান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যালঘু সমস্যা বুঝতে অক্ষম যার কারণে দেশে দীর্ঘসময় ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ হয়না। আদিবাসীরা ন্যায়ের এবং মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবি তুললে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দেওয়া হয়। তাদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকে রোধ করার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক লড়াই-সংগ্রামের ফল হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর আজ পর্যন্ত পাঁচটি নির্বাচিত দলীয় সরকার ও দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা এলেও চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তারা আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসেনি। পাহাড়ের তাই আমরা এখনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেখতে পাইনা।

শাহ আলম বলেন, পাহাড়ি জনগণকে তাদের অধিকার প্রদান না করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আরো বিপদগ্রস্ত হবে। স্বাধীনতা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে অনেকেই রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছে কিন্তু দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি হয়নি। একইভাবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতেও আমরা দেখি জুলাই আন্দোলনের নাম ভাঙিয়ে কতকিছুই হচ্ছে অথচ জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশ থেকে বৈষম্য দূর করা। বৈষম্য দূর হওয়া দূরের কথা আমরা নাগরিক অধিকারও হারাতে বসেছি এখন। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ আদিবাসীদের লড়াই-সংগ্রামে নীতিগতভাবে পাশে থেকেছি আগামীতেও থাকবো। ঐক্যবদ্ধ লড়াই করার কোন বিকল্প নেই।

প্রকৌশলী পরিমল কান্তি চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের সংকট সমাধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অতিদ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার যথাযথ সমাধান না হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরো জটিলতার দিকে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। কয়েক বছর অন্তর অন্তর সরকার পরিবর্তন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন হয়না। ২৮ বছর আগে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সরকার সেই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন করেনি উপরন্তু আদিবাসীদের উপর নিপীড়ন জারি রেখেছে।

ড. মুহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহিম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল পাহাড়ের রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি স্থাপন করা। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির মৌলিক ধারাসমুহ এখনও অবধি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে সেই প্রত্যাশিত শান্তি ফিরে আসেনি। এই চুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও তা আজ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে। এমন বাস্তবতায় পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি দিনদিন কঠোরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

শরৎজ্যোতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এখনও ২৫টি ধারা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো কিছু আংশিক ও কিছু পুরোপুরি অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। অবাস্তবায়িত ধারাগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই চুক্তির মৌলিক ধারা। এই মৌলিক ধারাসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য অঞ্চলে এখনও অস্থিতিশীল পরিবেশ জিইয়ে আছে। এই অস্থিতিশীল পরিবেশ একইসাথে পুরো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একটা ক্ষতিকর দিক। পার্বত্য চুক্তি এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যাকে সমাধানের উদ্দেশ্যে করা হয়, তাই এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে না এবং সম্ভবও নয়।

হাফিজ রশিদ খান বলেন, দেশে-বিদেশে স্বীকৃত একটি চুক্তির ২৮ বছর পরেও পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য দেশের নাগরিক সমাজের অন্যতম একটি অংশ বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা এখনও আন্দোলন সমাবেশ করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানকার নাগরিক সমাজ চেয়েছিল চুক্তির মাধ্যমে তাদের ভূমির অধিকারসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। তারা জনসংহতি সমিতির দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের সাথে সমবেত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকারও তাদের যে দাবিদাওয়া ছিল সেগুলোর সাথে একমত হয়ে চুক্তিতে উপনীত হয়। কিন্তু যখন চুক্তি স্বাক্ষরের ২৮ বছর পরও সেই অঙ্গীকার পূর্ণতা না পায় তখন আমাদের ভাবতে বাধ্য করে এখানে সরকারের দায়বদ্ধতার দুর্বলতা আছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজের কথা শুনতে পাচ্ছি। অন্তর্ভূক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনের জন্য পাহাড়িরা বঞ্চিত থাকবে কেন? পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নায্য অধিকার চুক্তির মাধ্যমে সরকার যেহেতু মেনে নিয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নের দায়িত্বও সরকারের।

অজিত দাশ বলেন, স্বাধীনতার আজ ৫৪ বছর পেরোতে যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত আমাদের সামাজিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুকিত, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে হচ্ছে। দেশে এখন যেভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান হচ্ছে এই পরিবেশে বাংলাদেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ টিকে থাকা মুশকিল। এই বাস্তবতায় দেশের সকল প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লড়াই-সংগ্রামে আমাদের সকলের পাশে থাকতে হবে।

প্রদীপ কুমার চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে কথা ছিল পাহাড়ি জুম্ম জনগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ অধিকার নিয়ে দেশের অন্যান্য নাগরিকের মত বেঁচে থাকবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের আজ ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তাদের নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদের শিকার হতে হচ্ছে, তাদের জীবনের নিরাপত্তার শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে। আমরা চাইনা পাহাড়ে অশান্তি থাকুক, স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তির বাস্তবায়ন অতীব জরুরি।

এছাড়াও আলোচনা সভায় সংহতি বক্তব্য রাখেন পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সভাপতি জগৎ জ্যোতি চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা ও ত্রিপুরা কল্যাণ ফোরামের সাবেক সভাপতি সুরেশ বরণ ত্রিপুরা প্রমুখ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও আলোচনা সভার সভাপতি তাপস হোড়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

More From Author