পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি: বাস্তবায়ন কতটুকু?

0
750

মঙ্গল কুমার চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩ বছর হয়ে গেলো। এই দিনে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়। বিগত ২৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কিছু ধারা-উপধারা বাস্তবায়িত হলেও এখনো দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ হয় সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে নতুবা ত্রুটিপূর্ণভাবে আংশিক বাস্তবায়িত করা হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথও আজ ধুলিস্যাত হতে বসেছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে বলে বলা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ সরকার বর্তমানে এক নাগাড়ে ১২ বৎসর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোন কার্যকর পদক্ষেপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। পার্বত্য চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত রেখে দিলেও সরকার উল্টো ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অব্যাহতভাবে অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা দেশে বিদেশে চালিয়ে যাচ্ছে।

যেমন চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাহাড়ি (উপজাতি) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে। সরকার দাবি করছে এই বিধানটি ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত’ হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ২৩ক উপ-অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, জাতিসত্তাসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। বস্তুত সরকার কর্তৃক যে দাবি করা হচ্ছে তা যথাযথ নয়।

চুক্তির এ বিধান সুনিশ্চিতকরণে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, পাহাড়ি অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সংরক্ষণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ শাসনকাঠামো স্থাপন, প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞার যথাযথ কার্যকরকরণ, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রভৃতি বিধানাবলী বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে। এছাড়া আনুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালে সরকারী প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে বারংবার জানানো হয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছেন যে উনিশ্শো আশি দশকে পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল অঞ্চলে পুনর্বাসন দেয়া হবে। কিন্তু এসব বিষয় এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

এছাড়া উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণকল্পে (১) সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বিভিন্ন ভাষা-ভাষী উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল মর্মে সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, (২) সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে “নারী বা শিশুদের অনুকুলে কিংবা নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের” শব্দসমূহের অব্যবহিত পরে ‘বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনগ্রসর পাহাড়িদের’ শব্দসমূহ সংযোজন করা, এবং (৩) উনিশ্শো আশি দশকে পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল জেলাগুলোতে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। কিন্তু অদ্যাবধি সরকার সেসব বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

আরো উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ২নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য বিভিন্ন আইন, বিধি ও প্রবিধান চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে সংশোধনের বিধান করা হয়েছে। সরকার দাবি করছে যে, এই বিধানটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। বস্তুত কেবল আঞ্চলিক পরিষদ আইন, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণীত হয়েছে। চুক্তির উক্ত বিধান কার্যকর করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন (আইন, বিধিমালা, আদেশ, পরিপত্র, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মবন্টন ইত্যাদি) যেমন- ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনসহ বিভিন্ন আইন সংশোধন করা অপরিহার্য। আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক বেশ কতিপয় আইন, বিধি ও পরিপত্র সংশোধন করার জন্য সুপারিশমালা পেশ করা হলেও সরকার কর্তৃক আজ অবধি কোন পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংশোধিত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থায় নানা ধরনের জটিলতা দেয়া দিচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকান্ড, তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা, আঞ্চলিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে ও ইহার পরামর্শক্রমে আইন প্রণয়ন, এনজিও কার্যক্রম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াদি তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করার বিধান রয়েছে। অপরদিকে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি সাধন এবং পুলিশ (স্থানীয়) বিষয়সমূহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত আওতাধীন বিষয়। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির দোহাই দিয়ে পূর্বেকার মতো আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধনের এখতিয়ারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জেলার সাধারণ প্রশাসন সম্পর্কিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন, অন্যদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ারকে খর্ব করে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জেলার ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তাই এ বিধান ‘সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত’ হয়েছে মর্মে সরকারের অভিমত সঠিক নয়।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ৩৩টি কার্যাবলীর মধ্যে ১৭টি বিষয়/কার্যাবলী হস্তান্তরিত হয়েছে। তবে তার মধ্যে ১২টি বিষয় অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সরকার রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ২৮টি করে এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ২৬টি বিষয় হস্তাস্তর করা হয়েছে বলে অপপ্রচার করছে। অপরদিকে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী যেমন- জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি সাধন; ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা; পুলিশ (স্থানীয়); বন ও পরিবেশ; যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়সমূহ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।

দীর্ঘ ১৫ ধরে টালবাহানার পর অবশেষে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’-এর বিরোধাত্মক ধারাসমূহ সংশোধন করে। কিন্তু এরপর সরকার আবার ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নে বিগত ৪ বছর ধরে টালবাহানা করে চলেছে। ভূমি কমিশনের এই বিধিমালা এখনো পর্যন্ত প্রণীত না হওয়ায় ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ শুরু করতে পারেনি। বিগত ২৩ বছরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সরকার ও জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ আসলেই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের ফিরিস্তি বড় করে তুলে ধরে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পানীয় জল ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে যে কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়নি তা বলা যেতে পারে না। তবে জাতীয় পর্যায় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এটাও সত্য যে, অধিকাংশ অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব এবং এতদাঞ্চলের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যতাকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে এসব উন্নয়নের ফলে পাহাড়ি জনগণের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকে দ্রুত ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে এবং এতদাঞ্চলের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যতার ভারসাম্য দ্রুত গতিতে নষ্ট করে ফেলছে। যার অন্যতম উদাহরণ চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা। ইতিমধ্যে এধরণের উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে ম্রো জনগোষ্ঠীসহ শত শত পাহাড়ি পরিবার স্ব স্ব গ্রাম ও ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। উক্ত পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের ফলে ম্রোদের আরো অনেক গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং প্রায় ১০ হাজার জুমচাষীর জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

বর্তমানে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো দমন-পীড়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পথ কার্যত বেছে নেয়া হয়েছে। যদিও বিগত সময়ে শ’ খানেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, কিন্তু এখনো ৪ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। অধিকন্তু চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সহযোগিতার নামে সরকার ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারি করে।

জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে। একদিকে ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অপপ্রচার করা, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের উপর বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত অবরুদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। ফলে জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবাদ মাধ্যম ও দেশবাসীর অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব পরিস্থিতির মতো অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে উঠছে।

মঙ্গল কুমার চাকমা: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক। E-mail: mkchakma@gmail.com