পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন: ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা

হিল ভয়েস, ১ ডিসেম্বর ২০২৫, ঢাকা: আজ সোমবার (১ ডিসেম্বর) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন- এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব জহুর হোসেন কনফারেন্স হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় এবং যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন-এর যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনে, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য প্রণব কুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি দীপক শীল, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে  মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত, বহু ভাষাভাষী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সংবিধানে তাদের পরিচয় অস্বীকার করার ঐতিহাসিক ভুলের কারণে জুম্ম জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক-মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দীর্ঘ দুই যুগের সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। আমরা আশা করেছিলাম, এই চুক্তি সেই ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের পথ দেখাবে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, প্রায় ২৮ বছর পরও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বৈষম্য ও শোষণ আজও অব্যাহত। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমরা চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার দাবি করলেও কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সভা বারবার স্থগিত হওয়া, টাস্কফোর্সের বৈঠক আটকে যাওয়া এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাধা- সবই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে বড় অন্তরায়। রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও সাম্প্রদায়িকতার মদদ পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে- যা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আজ ২৮ বছরে উপনীত। এই দীর্ঘ সময়ের কালক্ষেপণ চুক্তিটিকে কার্যত প্রতারণার দলিলে পরিণত করেছে। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে জুম্ম আদিবাসীরা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত এবং ক্রমাগত প্রান্তিকতায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পাহাড়ের সমস্যা শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৮ বছর পূর্ণ হতে চললেও এখনো এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। যে অংশগুলো বাস্তবায়নের দাবি করা হয়, সেগুলোরও কার্যকারিতা বাস্তবে স্পষ্ট নয়। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার যে অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছিল—তার মূল বক্তব্যই ছিল সকল ধরনের বৈষম্যের অবসান।

তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা চুক্তির আগে যেমন ছিল চুক্তির পরেও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ রয়েছে। ওই অঞ্চলে কার্যত একটি সেনাশাসনের বাস্তবতা এখনো বিরাজমান, যাকে অস্বীকার করা যায় না।

শামসুল হুদা অনুরোধ জানিয়ে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনী যেভাবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে ভূমিকা রেখেছে, ঠিক তেমনভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতেও সেনাবাহিনীকে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের জনগণ- বিশেষ করে পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টি রাখা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের জরুরি দায়িত্ব।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের পর থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ শাসন কাঠামোর আওতায় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে সবসময়ই একটি ‘বিশেষ সমস্যা’ হিসেবে দেখা হয়েছে। এমনকি ১৯৭৫ সালের সামরিক শাসনামলেও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পার্বত্য অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক আলোচনার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসে আলোচনার ভিত্তিতে অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির লক্ষ্য ছিল- পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অবিচার, ভূমি বিরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা সমস্যার সমাধান, এবং সংঘাতপীড়িত ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, চুক্তির মূল উদ্দেশ্য থেকে রাষ্ট্র অনেকটাই সরে গেছে, বরং সেখানে একটি বড় বাঙালি জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম বলেন, ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ি আদিবাসীরা আজ মানবিক সংকটে, যার সমাধান অধরাই রয়ে গেছে। শুধু পাহাড়িরাই নয়- স্থানীয় বাঙালিরাও নানা বঞ্চনার শিকার, ফলে পার্বত্য অঞ্চলে সামগ্রিক অধিকার সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। তাঁর মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কেবল ওই অঞ্চলের সমস্যা নয়, বরং এটি জাতির সার্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি জাতীয় সমস্যা।

২৪ জুলাইয়ের গণআন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আন্দোলনে বর্ণবাদ, চাকরি বৈষম্য, কোটা বৈষম্যসহ নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লাখো মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেখানে বিপুল সংখ্যক আদিবাসী অংশগ্রহণ করলেও তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা এখনো উপেক্ষিত।

অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জোর দাবি জানিয়ে বলেন, জাতীয় স্বার্থেই এখন এই চুক্তি বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। এসময় তিনি তিনটি দাবি তুলে ধরেন—

১. অনতিবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনরত পক্ষসমূহ এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপ আয়োজন করতে হবে।

২. পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা এবং চুক্তি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৩. আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করতে হবে।

More From Author