পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকগোষ্ঠীর শাসন ও রাজনীতি প্রসঙ্গে কিছু কথা

0
861
ফাইল ফটো

আবুমং মারমা

১.
পাহাড়ে শাসকগোষ্ঠী যে রাজনীতি গ্রহণ করেছে তা হলো, হয় জুম্ম জাতিকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণ (Ethnic Cleansing), না হয় জুম্মদেরকে তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জুম্ম মুক্ত পাহাড় গড়া। এই নীতিকে ঘিরে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন কলা-কৌশল অবলম্বন করে থাকে, পরিচালনা করে থাকে – এটাই শাসকের রাজনীতি।

সাধারণ মানুষ যারা মনে করেন, আমরা তো জুমিয়া (যারা জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা) মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ হয়ে পাহাড়ে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে না – সে খবর রেখে কী করবো। জুম চাষ করে দু’মুঠো ভাত খেতে পারলেই হয়। রাজনীতি আমাদের পোষায় না, আমরা ঐ সব ঝুট-ঝামেলায় থাকতে চাই না। তারা জানেন না যে, তারা পাহাড়ে কী ঘটছে, কী না ঘটছে, খবর না রাখলেও তারা রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, রাজনীতি তাদের জীবনমান, জীবন-জীবিকা, নিরাপত্তা সব ঠিক করে দিচ্ছে।

দেশ যেভাবে চলছে, দেশকে যেভাবে চালানো হচ্ছে, তাকে কপালের লিখন বা বিধাতার বিধান মনে করে অকপটে মেনে নেওয়াও এক ধরনের রাজনীতি; আবার এর প্রতিবাদ করাও আরেক রাজনীতি। যেমন, পাহাড়ে যারা শাসকগোষ্ঠীর শোষণমূলক ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা শাসননীতি মেনে নিয়েছে বা সহ্য করে চুপচাপ করে আছে এটাই তাদের রাজনীতি। এটা শাসকের রাজনীতি। আবার মেনে নিতে বা সহ্য করতে না পেরে যারা শাসকগোষ্ঠীর শাসননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, এটাও রাজনীতি। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যে নীতি-পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে, সেটাই রাজনীতি। এটা শাসিতের রাজনীতি। সমাজে যারা শোষিত, শাসিত, বঞ্চিত তারা তাদের স্বার্থ বুঝে নিজেদের রক্ষার জন্য যে নীতি-পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে তাদের রাজনীতি হলো শাসিতের রাজনীতি।

তাহলে আমরা দেখবো, পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই ধরনের রাজনীতি চলছে। এক. শাসকের রাজনীতি ও দুই. শাসিতের রাজনীতি। অর্থাৎ শাসকের রাজনীতি ও শাসিতের রাজনীতি এক নয় – যতক্ষণ সমাজে শাসক ও শাসিত এই দু’শ্রেণির অস্তিত্ব থাকবে। তাদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে।

এক. শাসকের রাজনীতি বলতে এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র (সেনাবাহিনী) পাহাড়ের ক্ষেত্রে যেসব নীতি-পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। আর এইসব নীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্ন কলা-কৌশল গ্রহণ করে থাকে। যেমন, জুম্ম নারীদের ওপর যৌন সহিসংতা, উন্নয়নের নামে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত বাস্তুভিটা-ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা, নিরাপত্তার নামে জুম্মদের ভূমি জোরপূর্বক বেদখল করে ক্যাম্প সম্প্রসারণ, নিরীহ প্রকৃতি ও দরিদ্রতার সুযোগে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জুম্মদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পাহাড়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি হলো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। আওয়ামী লীগ রাজনীতি বর্তমানে ফ্যাসীবাদী শক্তির রূপ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য এক সময় প্রগতিশীল ভূমিকার ভান করলেও, বর্তমানে একটি প্রতিক্রিয়াশীল রূপ নিয়েছে। জুম্মদের অধিকারের সনদ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’কে পূর্ণাঙ্গ ও দ্রুত বাস্তবায়ন না করে, তার বিপরীত ক্রমে চুক্তির লঙ্ঘনের কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছে। চুক্তি বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র চুক্তি বিরোধী কার্যক্রম নিয়ে যে ছঁক এঁকেছে, তা আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, দলীয় কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে চুক্তি বিরোধী বা পরিপন্থী কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। তাদের শাসননীতি মূলত শোষণের জন্য শাসন।

দুই. ঠিক এর বিপরীতে চলছে জুম্মদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের রাজনীতি। যা শাসিতের রাজনীতি। জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। বর্তমানও দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও জুম্ম জনগণকে চূড়ান্ত লক্ষ্য তথা শোষণমুক্ত বৈষম্যমুক্ত জুম্মদের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। একমাত্র জনসংহতি সমিতি প্রগতিশীল মতাদর্শ, মানবতার আদর্শ ও সঠিক রাজনৈতিক লাইন নিয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।

২.
পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের কি কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ আছে? জীবনের কোনো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আছে? অবশ্যই সেই পরিবেশ নেই। তাহলে জাতির কাজে যুক্ত হলে, অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির সাথে যুক্ত হলে কেন ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে?

পাহাড়ে জুম্মদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও নিরাপত্তাহীন জীবন হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। আর শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও নিরাপত্তাহীন জীবনের এই পরিবেশকে বদলিয়ে জুম্মদের নিশ্চিত ভবিষ্যত ও নিরাপদ জীবনের পরিবেশ সৃষ্টি করতেও রাজনীতি প্রয়োজন। সেই রাজনীতি হচ্ছে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি, অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। জ্ম্মু জাতির নিশ্চিত ভবিষ্যত ও নিরাপদ জীবন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরী। এটিই হচ্ছে বর্তমানে জুম্মদের একটি মহৎ কাজ, আর এই মহৎ কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিটি জুম্ম সদস্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই, জাতির এই মহৎ কাজে যুক্ত হলে, অধিকার প্রতিষ্ঠার (বিপ্লবী) রাজনীতির সাথে যুক্ত হলে ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে – এই চিন্তাধারাটি মারাত্মক ভুল। বরঞ্চ, আমরা যদি জাতির কাজে যুক্ত হতে না পারি, অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে যদি যুক্ত হতে না পারি, তাহলে আমরা একদিন পাহাড় থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবো তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বস্তুত পাহাড়ে জুম্ম সমাজের প্রত্যেক সভ্যরা রাজনীতি করুক বা না করুক, রাজনীতি পছন্দ করুক বা না করুক, চায় বা না চায়, আমরা কেউ এই দু’ধারার রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয় বা বাইরে থাকতে পারি না, পারবো না।

৩.
প্রসঙ্গত বর্তমানে বান্দরবানে শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত শাসননীতি বা রাজনীতির কলা-কৌশল নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজনবোধ করছি। বান্দরবানে জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনরত সংগঠন তথা পিসিজেএসএস’র সংগঠনের সাথে যুক্ত নেতৃত্ব, ব্যক্তি ও সর্মথকদের শূন্য করার নীতি গ্রহণ করেছে শাসকগোষ্ঠী। এই নীতিকে ঘিরে বিভিন্ন কলা-কৌশল প্রয়োগ করে রাজনীতি পরিচালিত করছে শাসকগোষ্ঠী।

এই কলা-কৌশলের মধ্যে যেটা প্রধান তা হচ্ছে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে যুক্ত সংগঠন, নেতৃত্ব, ব্যক্তি ও সর্মথকদেরকে ‘ইভল’ বা খারাপ (চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ট্যাগ লাগিয়ে) হিসেবে চিহ্নিত করে শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতির ন্যায্যতা দিয়ে মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয়। একজন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনকারীকে বিনা অপরাধে ধরপাকড় করে তাকে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করার চেষ্টা করা হয়। তারপর তাকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ করা হয়। যার ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় যারা জুম্ম জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছে, তারা নিরাপত্তার অভাবে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নসাৎ করার জন্য তার বিপরীত দল হিসেবে সংস্কারপন্থী দলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় সরাসরি খাগড়াছড়ি থেকে বান্দরবানে আনা হয়। সংস্কারপন্থী দল শাসকগোষ্ঠী গৃহীত নীতি বাস্তব রূপ দিতে ব্যর্থ হলে, এরপর মারমা লিবারেশন পার্টি (মগপার্টি)-কে রাজস্থলী থেকে বান্দরবানে সরাসরি কার্যক্রম চালাতে মোতায়েন করা হয়। বিশেষ করে রোয়াংছড়ি উপজেলার ২নং তারাছা ইউনিয়ন তথা বেতছড়া মৌজায় একটি অস্থায়ী ঘাঁটি তোলে মগ পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। জনসর্মথন না থাকায়, সে উদ্যোগটিও ব্যর্থ হয়। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলকেও একই উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়ি থেকে বান্দরবানে আনা হয়। তাদের কার্যক্রম আপাতত সদর ভিত্তিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। তাদের কার্যক্রম বলতে আপাতত চাঁদা তোলা ও মানুষজনকে হুমকি প্রদান করা, আর শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা। তাদের মধ্য দিয়ে বান্দরবানে পরিবেশ অশান্ত করা ও ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করা।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বাঙালি ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘বান্দরবানে প্রশাসনের নাকের ডগায়, সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগপার্টির লোকেরা চাঁদা তুলতে কীভাবে সাহস পায়’ এই কথাটি থেকে বুঝতে পারি, কে এদের আশ্রয়দাতা!আর শেষমেশ ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (বম পার্টি নামে খ্যাত) নামক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটানো হয়। এই দলটি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী তথা জনসংহতি সমিতিকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে উস্কানি ও মদদ দেয়া হয়। জনসংহতি সমিতির সদস্য তথা চুক্তি সমর্থকদের উপর আক্রমণ করার জন্য রোয়াংছড়ি উপজেলার অন্তর্গত রনিন বম পাড়াতে সেনাবাহিনীর সাথে বমপার্টির বৈঠকও হয়েছিল বলে জানা যায়। কুকি-চিনরা আপাতত রোয়াংছড়ি, রুমা, বিলাইছড়ি সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প আছে বলে জানা যায়।

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা, রুমা উপজেলার বিভিন্ন পাড়ায় ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ জেএসএস সংগঠনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের অবস্থানের খবর নিচ্ছে বলে জানা যায়। তারা পিসিজেএসএস কর্মীদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে তাদের লোকজন তৎপর রয়েছে বলে জানা যায়।

বান্দরবানে পিসিজেএসএস সংগঠনের সাথে যুক্ত ব্যক্তি, সর্মথকদের ধরপাকড় ও দমন-পীড়ন হতে পারে যে কোন মুহূর্তে। সেই ব্যাপারে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগ পার্টি সংগঠনকেও তৎপর করা হয়েছে। এই দলগুলির কার্যক্রমের মধ্যে কোনো নীতি-আদর্শের বালাই নেই, আছে শুধু সেনাবাহিনীদের গোলামী করা, দালালি করা।

রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য পাহাড়ের আন্দোলন দমিয়ে রাখা এবং পাহাড়িদের বিভক্ত করে শাসন-শোষণ চালিয়ে যাওয়া। বিভক্ত করে জুম্মদের আন্দোলনের শক্তিকে দূর্বল করে ফেলা। শাসকগোষ্ঠী তার প্রয়োজনে সৃষ্টি করে, লালন করে এবং কৌশলে তাতে ইন্ধন যোগায় । জুম্মদের মধ্যে আলাদা আলাদা জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি করে জাতিগত বিভেদ করে ভূঁইফোড় সংগঠন সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দেওয়া, শাসন-শোষণ করা, আর ঐক্য শক্তিকে দূর্বল করা। ইদানিং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মগ পার্টির নতুন সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়। সেখানে মারমা ভাষা দিয়ে বলা হয় যে, জেএসএসকে মারার জন্য কমান্ডো ট্রেনিং চলছে। রাজস্থলী গ্যাইন্দা ইউনিয়নের অন্তর্গত পোয়াইতু পাড়া হচ্ছে মগ পার্টির প্রধান সামরিক ঘাঁটি। পোয়াইতু পাড়াতে মগ পার্টির সদস্যরা পরিবারসহ রয়েছে বলে জানা যায়। পোয়াইতু পাড়ায় তাদের ক্যাম্পে সেনাবাহিনী তথা প্রশাসনের নাকের ডগায় মগ পার্টির সামরিক প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল করা হয়। অথচ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে।

অপরদিকে পিসিজেএসএসের ছাত্র সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ’-এর বিপরীতে শাসকগোষ্ঠী সৃষ্টি করে নিলো ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’এর নেতৃত্বে ‘পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ’। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিভিন্ন অর্থ ও সহযোগিতার লোভ দেখিয়ে বা বিভিন্ন চাপের মধ্যে ফেলে তাদের বিভিন্ন কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সংগঠনের সভাপতি উচিং মারমার নেতৃত্বে প্রতিনিয়ত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিভিন্নভাবে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। বিশেষ করে দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসা মেঘলায় টেকনিকাল স্কুল এন্ড কলেজে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের অনিচ্ছা সত্বেও চাপ প্রয়োগ করে তাদেরকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আর তারা যখন সংগঠনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও চরিত্র জানতে পেরে কমিটি থেকে অব্যাহতি দিতে চায়, তখন তাদেরকে মেরে ফেলা, বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হয় বলে জানা যায়।

অন্যদিকে গত ১৯ মে ২০২২ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের চেমিডলু পাড়া এলাকা থেকে আটক করা হয় জেএসএসের পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ-এর দুই নেতাকে। অবশেষে মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। একই দিনে রাজনৈতিক দল থেকে বহু হাত দূরে এমন নিরীহ চার জুম্মকেও গ্রেপ্তার করে একই মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এখানে দু’টো ঘটনার মধ্যে দুইজন ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত আর চারজন রাজনীতি থেকে বহু দূরে ছিল। তারা সাধারণত গাছ কাটতে যাওয়া শ্রমিক ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তারা রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও শাসকগোষ্ঠীর হিংসাত্মক রাজনীতি বা দমননীতি থেকে রেহাই পায়নি।

পরিশেষে বলতে চাই, সাতে-পাঁচে থাকবো না, আমি নিউট্র্যাল (নিরপেক্ষ) – এই চিন্তাধারা ভুল। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা এর মধ্যে নিউট্র্যাল বলে কিছু থাকতে পারে না। রাজনীতি বললেই ভাবা উচিত কোন শ্রেনির প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতি। মানে কোন ধরনের রাজনীতি। শাসকের রাজনীতি না, শাসিতের রাজনীতি।

তাই প্রশ্ন হচ্ছে, শাসকগোষ্ঠীর নেতৃত্বে পরিচালিত জাতীয় রাজনীতি বা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, উগ্র ইসলামিক সম্প্রসারণবাদ ও মৌলবাদী শক্তির সাথে যুক্ত হয়ে জুম্ম জাতিকে ধ্বংসের কার্যক্রমে সামিল হবেন? নাকি শাসকগোষ্ঠীর প্রয়োজনে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মগ পার্টি, সংস্কারপন্থী, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট দলের সাথে যুক্ত হয়ে জুম্ম জাতির সাথে বেঈমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা করবেন? নাকি মানবতার আদর্শ, প্রগতিশীল মতাদর্শ নিয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত পিসিজেএসএস পার্টির সাথে একাত্ম হয়ে যুব সমাজের ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক মহৎ দায়িত্ব পালন করে জাতিকে মুক্তি এনে দিবেন?

আমি ব্যক্তিগতভাবে পাহাড়ে রাজনৈতিক শক্তি বলতে এই দু’ধারার রাজনীতিকে বুঝি। এই দু’ধারা রাজনীতি দ্বারা আমরা পরিচালিত হচ্ছি। আর আমরা কেউ এই দু’ধারা রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়, আর থাকতেও পারে না। তাই এই দু’ধারা রাজনীতির মাঝখানে কিছু নেই!