পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার লংঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ প্রকাশ

হিল ভয়েস, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জাতিসংঘের স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউর ও ম্যান্ডেটধারীদের একটি দল পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ-এর নিকট যৌথ অভিযোগপত্রাবলী পাঠিয়েছে। ইউএনপিও (আনরিপ্রেজেন্টেড ন্যাশন্স এন্ড পিপল্স অরগানাইজেশন) ও পিসিজেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) কর্তৃক বান্দরবান জেলায় চলমান ভূমি বেদখল ও মানবাধিকার লংঘনকে জোর দিয়ে জাতিসংঘের স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউরদের নিকট পেশকৃত একটি যৌথ প্রতিবেদন অনুসরণ করে এই অভিযোগপত্রসমূহ পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি দীর্ঘ সময় ধরে জাতিগত উত্তেজনা, ভূমি বিরোধ ও স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সংগ্রামের মধ্যে প্রোথিত সহিংসতার দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহ দীর্ঘ সময় ধরে ভূমি বেদখল, একতরফা আটক, জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও পরিবেশের ধ্বংসসাধন সহ চলমান মানবাধিকার লংঘনের সম্মুখীন হয়ে আসছে। এইসব মানবাধিকার লংঘনের মধ্যে সাম্প্রতিক সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ হল বান্দরবান জেলায় রাবার বাগান পরিচালনাকারী একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সম্পর্কিত একটি মামলা। ২০২২ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সমর্থিত এই কোম্পানিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন ভূমি বেদখলে নেতৃত্ব দিয়েছে, যা মানুষ ও পরিবেশের ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। প্রতিরোধকারী সামাজিক নেতারা এবং মানবাধিকার সুরক্ষাকর্মীরা হুমকি, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ ও প্রায়ই সহিংস দমননীতির সম্মুখীন হন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ২০২২ সালে দায়ের করা লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ মিঃ রিংরং ম্রো নামে একজন আদিবাসী সুরক্ষাকারীকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়। রাবার কোম্পানি কর্তৃক আদিবাসীদের পূর্বপুরুষের ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকালে ম্রো ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে ‘বেআইনি সমাবেশ এবং আগুন বা বিস্ফোরক বস্তু’ দিয়ে অনিষ্ট করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তাকে বান্দরবান জেলা কারাগারে আটক রাখা হয় এবং ২৮ মার্চ ২০২৫ ছেড়ে দেওয়া হয়। অধিকার গ্রুপসমূহ এই গ্রেপ্তার ও আটকের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার সুরক্ষাকারী ও আদিবাসী সামাজিক নেতাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিতকরণ সহ আইনি নিপীড়নের এই ক্রমবর্ধমান ধারার বিষয়ে স্পেশ্যাল প্রসিডিউরগণ কর্তৃক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের বরাবরে লিখিত যৌথ অভিযোগপত্রাবলীতে, তারা জোর দিয়ে বলেন যে, এই ধরনের কার্যক্রম ঐ অঞ্চলে মানবাধিকারের কাজকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

এছাড়া যৌথ অভিযোগপত্রাবলীতে ভূমি বেদখলের অভিযোগে অভিযুক্ত একটি প্রাইভেট কোম্পানি কর্তৃক দায়ের করা অভিযোগে স্থানীয় নেতা রিংরং ম্রোকে একতরফা গ্রেপ্তারের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। যেহেতু এই ভূমি বেদখল সরাসরি স্বায়ত্তশাসন ও ভূমির উপর আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিতের অঙ্গীকার প্রদানকারী ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লংঘন করে, তাই এই গ্রেপ্তারের সময় ও উদ্দেশ্য অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে ধরে। এই আলোকে স্পেশ্যাল প্রসিডিউরগণ বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানায়, অন্যান্যের মধ্যে যাতে তারা তাদের কর্মপরিধির আওতাধীন করণীয়সমূহ তাদের মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতাসমূহকে সম্মান করে তা নিশ্চিতকরণে এবং পরিবেশ ও ভূমি মানবাধিকার সুরক্ষাকারীদের, নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে তাদের সক্ষম করে গড়ে তুলে, সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ-কে সম্বোধন করে লিখিত আলাদা এক চিঠিতে, জাতিসংঘের মানবাধিকার ম্যান্ডেটধারীগণ ভূমি বেদখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা পার্বত্য চুক্তি লংঘন করে ৩,৫০০ একর ভূমি বেদখল এবং জল দূষিত করার মাধ্যমে আদিবাসীদের হুমকি, আদিবাসীদের ভূমি জোরপূর্বক দখল করার জন্য বহিরাগত শ্রমিকদের ভাড়াকরণ ও চাষের জমিতে অগ্নিসংযোগ-কে উল্লেখযোগ্যভাবে তুলে ধরেন। ফলে স্থানীয় সম্প্রদায় খাদ্য ও পানি সংকটের সম্মুখীন হন, যেগুলি মানবাধিকারের প্রচেষ্টাগুলির মাধ্যমে উপশম করা সম্ভব ছিল না।

স্পেশ্যাল প্রসিডিউরগণ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজকে আহ্বান জানায়, যাতে তারা ভূমি বিরোধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আইনি বাধ্যবাধকতাসমূহ শ্রদ্ধা করতে এবং তাদের কার্যক্রমের প্রতিকূল মানবাধিকার প্রভাব প্রশমনে ও প্রতিকারে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা গুরুত্বসহকারে স্বীকার করেন যে, ‘আদিবাসীদের সম্মতি ব্যতিরেকে পূর্ববর্তী ভূমি অধিগ্রহণ ও লীজসমূহ ছিল অন্যায্য এবং ঐ ভূমি ইহার প্রকৃত মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’

নিম্নোক্ত জাতিসংঘের স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউর ও ওয়ার্কিং গ্রুপ বিশেষজ্ঞগণ, যারা তাদের স্ব স্ব ম্যান্ডেটের দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের কর্তৃক অভিযোগপত্রসূহ প্রেরণ করা হয়-
● মানবাধিকার সুরক্ষাকারীদের পরিস্থিতি সংক্রান্ত স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউর
● একতরফা আটক সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের যোগাযোগ বিষয়ক ভাইস-চেয়ার
● মানবাধিকার ও আন্তঃজাতীয় কর্পোরেশন এবং অন্যান্য ব্যবসায় উদ্যোগ-এর বিষয় সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের চেয়ার-র‌্যাপোর্টিউর
● মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার-এর উন্নয়ন ও সুরক্ষা সংক্রান্ত স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউর
● শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সমিতি-এর স্বাধীনতার অধিকার সংক্রান্ত স্পেশ্যাল র‌্যাপোর্টিউর
সূত্র: https://unpo.org

More From Author

+ There are no comments

Add yours