পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি

0
349

৬ষ্ঠ অংশ: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন
মঙ্গল কুমার চাকমা

২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদল হেলিকপ্টার যোগে সেদিন দুপুর সোয়া দুইটায় ঢাকা থেকে ধুধুকছড়ায় ফেরেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী ও আরেক অন্যতম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সার জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলকে ধুধুকছড়ায় পৌঁছে দেন। হেলিকপ্টার থেকে ধুধুকছড়ায় পা রাখার সাথে সাথে হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে জয়ধ্বনি দিয়ে জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান। ছোট শিশুরা জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের প্রধান ও প্রাণপ্রিয় নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাকে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে বরণ করে নেয়। সেই সময় উপস্থিত জনতার প্রতি এক বক্তব্যে শ্রী লারমা বলেন, “চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তিতে জুম্ম জনগণের যথেষ্ট দাবি আদায় হয়েছে। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের কারণেই এ দাবি আদায় সম্ভব হয়েছে। …জনসভায় সন্তু লারমা বলেন, দেশ ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার নিরিখেই আমরা চুক্তি সই করেছি। আজ যারা চুক্তির বিরোধিতা করছে তারা জাতির জন্য কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছে? সন্তু লারমা বলেন, আমরা দীর্ঘজীবন অনেক আন্দোলন করে আজ জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা স্তম্ভ রচনা করতে চাই। ..এ চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। …তিনি বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন এখন থেকেই শুরু হয়েছে। তিনি পার্বত্য এলাকার উন্নতির জন্য সরকার ও দেশবাসীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, আমরা শান্তিতে সকলেই একসঙ্গে বসবাস করতে চাই।” (দৈনিক সংবাদ, ৩ ডিসেম্বর ১৯৯৭)।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জুম্ম জনগণসহ দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি এই চুক্তিকে পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে। জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র, মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ এই চুক্তিকে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় পার্টি ও জামাতে ইসলামী প্রভৃতি দেশের চরম দক্ষিণপন্থী জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। এই চুক্তিকে দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী এবং দেশ বিক্রির সামিল বলে তারা অপপ্রচার চালায়।

ইউপিডিএফের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী চক্রান্ত

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে না হতেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে বিরোধিতা করে প্রসিত বিকাশ খীসা ও রবি শংকর চাকমার নেতৃত্বে পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর চুক্তি বিরোধী এই গোষ্ঠী ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (ইউপিডিএফ) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’ আদায়ের নামে সেনাবাহিনী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মদদে ইউপিডিএফ জনসংহতি সমিতির সদস্য ও সমর্থকদের খুন-অপহরণসহ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী তথাকথিত ইউপিডিএফ’কে প্রথমে আওয়ামী লীগ নানাভাবে রাজনৈতিক মদদ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চলেছে, তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ মহলও নানাভাবে এইসব সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে চলেছে। মূলত সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার চুক্তিবিরোধী ও কায়েমি স্বার্থবাদী একটি মহলই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেনেশুনে চুক্তিবিরোধী এই গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে থাকে। বর্তমান জোট সরকারের একটা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও সন্ত্রাসী প্রসিত-রবিশংকর গ্রুপকে নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চলেছে। ইউপিডিএফ যেসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জনসংহতি সমিতি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের হত্যা-অপহরণ-হামলা করা, একইভাবে জুম্ম জনগণকে ব্যাপকহারে চাঁদা দিতে বাধ্য করা। এই প্রসিত-রবিশংকর চক্র শুধু জুম্ম জনগণকে ক্ষতি করছে তাই নয়, বিদেশী নাগরিকদেরও অপহরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কাজে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে।

সেনাবাহিনী তথা সরকারের বিশেষ মহল পূর্বের মতো চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসী ইউপিডিএফ’কে মদদ দিয়ে চলেছে। সেনাবাহিনী ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অবাধে চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে চলেছে। প্রশাসনের একটি বিশেষ মহলের ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অবাধে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর এযাবৎ এই চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থী সন্ত্রাসীরা জনসংহতি সমিতির ৯৬ জন সদস্যসহ তিন শতাধিক লোককে খুন ও অসংখ্য নিরীহ লোককে অপহরণ ও নির্যাতন করেছে। সরকারের নির্লিপ্ততা তথা প্রকারান্তরে পরোক্ষ মদদদানের কারণে সংস্কারপন্থী-ইউপিডিএফ এভাবে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে।

জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বন্ধের জন্য জনসংহতি সমিতি ইউপিডিএফের সাথে সংলাপে বসেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফর মধ্যে কয়েকবার সমঝোতা হয়েছিল। প্রসিত-সঞ্চয় গ্রæপের একগুয়েমী ও চুক্তিবিরোধী ষড়যন্ত্রকে পরিত্যাগ করতে না পারার ফলে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেই বৈঠকের অপমৃত্যু ঘটে। সরকারি বাহিনী তথা শাসকশ্রেণির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে প্রসিত-রবিশঙ্কর গ্রুপ তথা ইউপিডিএফের সশস্ত্র প্রতিবন্ধকতা সত্তে ও জনসংহতি সমিতি নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে।

আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন

শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার ১৯৯৭ সালে জুম্ম জনগণের শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করলেও চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও সরকার চুক্তির স্বশাসনমূলক বিধানাবলী বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ফলে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর যতই দিন যেতে থাকে, ততই শেখ হাসিনা সরকার অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে থাকে। তাই জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আড়াই দশক ধরে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসতে বাধ্য হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কর্মসূচি হলো-

  • চুক্তি মোতাবেক যথাযথভাবে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের গড়িমসির বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে প্রতিবাদ।
  • ১৯ জুলাই ১৯৯৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকে সেটেলার বাঙালিদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উদ্যোগের প্রতিবাদে টাস্কফোর্স সভা বর্জন।
  • তিন সার্কেল চীফের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলায় জেলা প্রশাসকরা স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র ইস্যু করতে পারবেন মর্মে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এক অফিসাদেশ জারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
  • চুক্তির সাথে বিরোধাত্মকভাবে ১৭ জুলাই ২০০১ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ জাতীয় সংসদে পাশ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
  • পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় খাগড়াছড়ি জেলার সদর ও মহালছড়ি উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়াগা-জমি জবরদখল করে সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
  • ১ সেপ্টেম্বর ২০০১ হতে একতরফাভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
  • ২০০১ সালে নির্বাচন বর্জন ও স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের দাবি।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জনসংহতি সমিতির অব্যাহত প্রচার কার্য এবং দেশে-বিদেশে পার্বত্য চুক্তির প্রতি ব্যাপক জনমতের কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল করার কথা বলতে সাহস করেনি। তবে চুক্তি বাতিল না করলেও চার দলীয় জোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নানাভাবে ক্ষুন্ন করে। চারদলীয় সরকারের আমলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের সাথে জনসংহতি সমিতি অব্যাহতভাবে একাধারে সংলাপ ও আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে একের পর এক হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে এসেছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো-

  • টাস্কফোসের চেয়ারম্যান এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ থেকে উপজাতীয়দের অপসারণের দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন।
  • ২০০৩ সালে ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের রেশন প্রদান বন্ধকরণে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

২০০৩ ও ২০০৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়রাম্যান পদ থেকে অপসারণ, ‘অপারেশন উত্তরন”সহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে উপজাতীয়দের মধ্য হতে একজন পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ করা ইত্যাদি চারদফার দাবিতে হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন।

জরুরী অবস্থা জারি ও পার্টির মধ্যে উপদলীয় চক্রান্ত 

২-৪ মার্চ ২০০৬ সালে রাঙ্গামাটির বালুখালীস্থ টুকটুক ইকো ভিলেজে জনসংহতি সমিতির ৮ম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সত্যবীর দেওয়ানকে নির্বাচিত করা হয়। উক্ত সম্মেলনে সুধাসিন্ধু খীসা, রূপায়ন দেওয়ান, তাতিন্দ্র লাল চাকমা ও চন্দ্রশেখর চাকমার নেতৃত্বে কতিপয় সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালিপ্সু সদস্য উপদলীয় চক্রান্ত চালান। পরবর্তীতে দেশে জরুরী অবস্থা জারি হলে ক্ষুদে দলবাদীদের চক্রান্ত আরো জোরদার হয়ে উঠে।

১/১১ এর পর দেশে জরুরী অবস্থা জারি হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। জরুরী অবস্থার সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সেনাবাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। এই সুযোগে জরুরী অবস্থাকে ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা অধিকতর জোরদার হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাস ও ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীর জুম্ম স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে চিরতরে ধ্বংস করা এবং জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রামকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীসহ ১/১১ এর কর্ণধাররা জরুরী অবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

এ সময়ে ভূমি অধিকারসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সোচ্চার জুম্মদের অনেক সংগঠক ও কর্মীদেরকে হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেফতার ও জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়। তাদের মধ্যে অনেককে অতি স্বল্প সময়ে নিষ্পন্ন প্রহসনমূলক বিচারে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পার্বত্যাঞ্চলের অধিবাসীরা একই সময়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ ও ‘জরুরী অবস্থা’ এই উভয় সামরিক শাসনের মধ্যে নিপতিত হয়। জুম্ম জনগণ প্রচন্ড দমন-পীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। অন্যদিকে পার্টির সভাপতিসহ শতাধিক সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথা মামলা দায়ের করে। শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় সেনা ক্যাম্প কর্তৃক পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে জনসংহতি সমিতি ছেড়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়। অন্যথায় ক্রশ ফায়ারে হত্যা, মামলা-মোকদ্দমা, চরম নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখোমুখী হতে হবে বলে হুমকি দেয়া হয়।

সারাদেশের কথিত ‘মাইনাস টু’ তত্তে মাধ্যমে কিংবা কিং পার্টি গঠনের মাধ্যমে তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামেও সেনাবাহিনী ‘মাইনাস সন্তু লারমা’ তত্ত এবং পার্টির কতিপয় উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালিপ্সু স্বার্থান্বেষী নেতৃস্থানীয় সদস্যের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে কিং পার্টি গঠনের নীল-নক্সা হাতে নেয়। একদিকে জেল-জুলুমের ভয়ে, অন্যদিকে ক্ষমতার লোভে মদমত্ত হয়ে পার্টির কতিপয় নেতৃস্থানীয় সদস্য শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ বাহিনীর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে পার্টির সভাপতি ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা ও অপপ্রচার শুরু করে। এসব সুবিধাবাদী ও আদর্শচ্যুত সদস্যরা তাদের মতামত ও অভিযোগ পদ্ধতিগতভাবে তুলে না ধরে পার্টি গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলা-পরিপন্থীভাবে যত্রতত্র প্রচার করে কর্মী বাহিনী ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার হীনতৎপরতা চালাতে থাকে। এই গোষ্ঠীর চিহ্নিত কতিপয় সদস্য এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য পদ লাভে মরিয়া হয়ে উঠে। তাতে পার্টি নেতৃত্ব এক বিশেষ সংকটের মুখোমুখী হতে বাধ্য হয়। শাসকগোষ্ঠীর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে সুধাসিন্ধু-রূপায়ণ-চন্দ্রশেখর-তাতিন্দ্র চার কুচক্রী জনসংহতি সমিতিকে বিভক্ত করে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালায়। ফলত পার্টির নেতৃত্বকে এক চরম কঠিন অবস্থার মোকাবেলা করতে হয়েছে। জনসংহতি সমিতির সদস্যদের কয়েক শত পরিবারকে স্ব স্ব গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করেছে।

দেশে জরুরী অবস্থাকে ব্যবহার করে যেখানে শাসকগোষ্ঠী পার্টির নেতৃত্ব ও সংগঠনের উপর একের পর এক নির্মম দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল এবং তৎকারণে পার্টির নেতৃত্ব ও সংগঠন ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পর্যবসিত হচ্ছিল সেই অবস্থায় পার্টির নেতৃত্ব ও সাংগঠনকে রক্ষা করা এবং তজ্জন্য অধিকতর ঐক্যবদ্ধ করার পরিবর্তে তারা ক্ষুদে দলবাদী হয়ে বিভেদপন্থা অবলম্বন করে এবং তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কারের হীনকর্মসূচীতে পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকা গ্রহণ করে। শুধু তাই নয়, এই আদর্শ-বিচ্যুত ক্ষুদে দলবাদী গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্য পদসহ শাসকগোষ্ঠীর উচ্ছিষ্ট লাভের উদগ্র লোভে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পার্টি প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশে জরুরী অবস্থা উঠে গেলে পার্টির সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। সাজানো মিথ্যা মামলার ভয়ে যারা এলাকা ছাড়া হয়েছে তারা ধীরে ধীরে স্ব স্ব কর্মএলাকায় ফিরে আসতে থাকেন। গ্রেপ্তারকৃত অনেকে জামিনে মুক্তিলাভ করেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন স্তরের পার্টি সংগঠন সক্রিয় হতে থাকে।

সংস্কারপন্থী নামে খ্যাত এসব সদস্যরা পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) নামে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন। গত ২৭ জানুয়ারি ২০১০ খাগড়াছড়ি যাওয়ার পথে পার্টি শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কাজে লিপ্ত ক্ষুদে দলবাদীদের সহযোগে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পার্টি সভাপতি সন্তু লারমার উপর বর্বরোচিত হামলা চালায়।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা ড. ফখরুউদ্দিনের তত্তাবধায়ক সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

মহাজোট সরকারের আমলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার। নির্বাচনী অঙ্গীকারে দেশে গণতন্ত্রায়ণ, রাজনীতির অসাম্প্রদায়িকীকরণ, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দারিদ্র দূরীকরণ, বেকার সমস্যার সমাধানসহ দেশের মানুষের দিন বদলের ডাক দিয়েছিল আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন এই মহাজোট। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করা হয়েছে যে- “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে জনমনে আশার আলো সঞ্চারিত হয়। জনসংহতি সমিতি ও সমিতির সভাপতি সন্তু লারমাও চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্য মহাজোট সরকারের সাথে, বিশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দফায় দফায় বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে (২০০৯-২০১৮) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার অন্তত ৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিতীয় বার বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো পরিচিহ্নিত করে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যেসব বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি তার বিবরণ” শীর্ষক ১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন এবং তৎসঙ্গে সহায়ক দলিল হিসেবে ১৬টি পরিশিষ্ট সংযুক্ত করে ১ এপ্রিল ২০১৫ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করা। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সন্তু লারমা কর্তৃক প্রামাণিক দলিলাদিসহ পার্বত্য চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ লিখিতভাবে দাখিল করা সত্তে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে উক্ত প্রদিবেদন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে দৃশ্যমান হয়নি।

দ্বিতীয়ত ১ জানুয়ারি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বৈঠকও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রী লারমা তাঁর দুইজন শীর্ষস্থানীয় সহযোগীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ৮টি অগ্রাধিকার বিষয় লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করেন। কিন্তু তা সত্তে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে মহাজোট সরকারের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১০ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো-

  • ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে পার্বত্য চুক্তি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উপর জনসংহতি সমিতির প্রতিবাদ।
  • ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন কালে পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি।
  • চুক্তির সাথে ভূমি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের আন্দোলন।
  • ২০১৩ সালে চুক্তিকে পদদলিত করে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
  • ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ১১ নির্দেশনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বাতিলের দাবি।
  • ১০ দফা কর্মসূচি ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন।

উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে অব্যাহতভাবে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৯৯৭-২০০১), প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (২০০১-২০০৬) ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (২০০৯-২০১৮) এর সাথে কমপক্ষে ২০টির অধিক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে প্রত্যেকেই সন্তু লারমার বক্তব্য ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন এবং অনেক বিষয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বৈঠকের পর কার্যত পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কেউই এগিয়ে আসেননি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং কেবল প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন, বস্তুত বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। বরঞ্চ চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম হাতে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে চলেছে।

জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে অপরাধীকরণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে ক্রিমিনালাইজ করার জন্য সরকারের প্রভাবশালী বিশেষ মহল নানা ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, মারধর, হয়রানি ইত্যাদি ফ্যাসীবাদী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

সরকার কেবল এধরনের চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রমের মধ্যেই ক্ষান্ত থাকেনি, ‘ভাগ করো শাসন করো’ ঔপনিবেশিক নীতির ভিত্তিতে সরকারের বিশেষ মহলের মাধ্যমে জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল, সুবিধাবাদী ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করে দিয়ে এবং তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে চলেছে। সরকারের বিশেষ মহল কর্তৃক সৃষ্ট প্রসিত নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী খ্যাত জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), মগ পার্টি খ্যাত এমএনপি ইত্যাদি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের পর সর্বশেষ সশস্ত্র গ্রুপ বমপার্টি খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) গঠিত হয়েছে।

বস্তুত সরকারের মদদে এভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিশেষ মহল একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, অপরদিকে সন্ত্রাসী দমনের নামে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার দায়ভার সমিতির উপর চাপিয়ে দিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগসহ জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে যুক্ত জুম্মদের সুবিধাবাদী, ক্ষমতালিপ্সু ও তাঁবেদার লোকদেরকে মদদ দিয়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতিকে ধ্বংস করতে সরকার এখন উঠে পড়ে লেগেছে।

পার্বত্য চুক্তির পূর্বেও শাসকগোষ্ঠী নামে-বেনামে সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও লাঠিয়াল বাহিনী সৃষ্টি করে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বাধীন জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু জুম্ম জনগণের ঐক্যবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি শাসকগোষ্ঠীর সেসব সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। চুক্তি-উত্তর সময়েও বিগত আড়াই দশক ধরে জনসংহতি সমিতি সেনাবাহিনী মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ শাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আসছে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে।