হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২৫, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ত্রিপুরা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ক্যাম্পেইন ফর হিউম্যানিটি প্রোটেকশন (সিএইচপি)’ এর উদ্যোগে আজ মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর ২০২৫) আগরতলার প্রেসক্লাবে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আলোকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সিএইচপির সভাপতি বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক নিরঞ্জন চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভাটি সঞ্চালনা করেন সিএইচপির সাধারণ সম্পাদক প্রিয় লাল চাকমা। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নর্থইস্ট লাইভ নিউজ চ্যানেলের সহকারী সম্পাদক পিনাকী দাস, বিশিষ্ট গবেষক ড. শ্যামল বিকাশ চাকমা, সাবেক বিএসি চেয়্যারম্যান বিপাংশু চাকমা, ইন্টারন্যাশনাল চাকমা ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রগতি চাকমা, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও সিএইচপির সহ-সভাপতি নয়ন জ্যোতি ত্রিপুরা।
নর্থ-ইষ্ট লাইভ নিউজ চ্যানেলের সহকারী সম্পাদক পিনাকী দাস বলেন, পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে চুপ করে থাকার কোন কারণ নেই। কারণ সেই আগুন নিজের বাড়িতেও লাগবে। প্রতিবেশি দেশে নেতিবাচক পরিবর্তন হলে নিজের দেশেও তার প্রভাব পড়বে। কাজেই আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ভাবতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, যা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজাতি আন্দোলনে ভারতীয় জনগণের সহায়তা করতে হবে।
টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোসিয়াল সায়েন্স- এর গবেষক ড. শ্যামল বিকাশ চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে ভারতের জনগণের একটা দায়িত্ব রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নয়, এটা ভারতের নিরাপত্তার সাথেও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে ভারতের জনগণের ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রগতি চাকমা বলেন, ১৯০০ রেগুলেশন পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের রক্ষাকবচ ছিল। তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকার অমান্য করে চলেছে। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর সেনাবাহিনী অভিযানের নামে জুম্ম অধ্যুষিত এলাকায় মারধর, ধরপাকড়, হয়রানি, যৌন হয়রানি ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শান্তির উদ্দেশ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ ধরে নিয়েছিল এই চুক্তির মাধ্যমে একটু শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু সরকার চুক্তি কিছু অংশ বাস্তবায়ন করার পর বাকি গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো বাস্তবায়ন না করায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে, পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নিতে হবে এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
বিপাংশু চাকমা বলেন, একটি জাতি বাঁচতে গেলে সম্মানজনকভাবে টিকে থাকতে চাইলে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে হয়। কোন একটি জাতির উপর যদি অন্যায়ভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয় তাহলে অন্য জায়গায় যারা ভাল থাকে তাদের উপর সহানুভুতি থাকতে হবে। আমরা জানি, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চুক্তির যতটুকু বাস্তবায়ন হওয়ার কথা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের নিকট চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
নয়ন জ্যোতি ত্রিপুরা বলেন, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তির আজ ২৮ বছর পূর্ণ হলো। আজকের এই দিনটি খুবই উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করার কথা ছিল। যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নীপিড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্যই এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় আজ ২৮ বছরেও সরকার সেই চুক্তি বাস্তবায়নের কোন স্বদিচ্ছা রাখেনি।
নিরঞ্জন চাকমা বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু পাকিস্তান এরপর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম মানুষের দুর্ভাগ্য আজও তারা করে বেড়ায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের উপর নির্যাতন নিপীড়ন থেমে নেই। তিনি ১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দুঃসহকর সময় বলে অভিহিত করেন। কেননা সেদিন ৯৮ শতাংশ অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেজন্যই চাকমারা ১৭ই আগস্টকে চাকমা কালো দিবস হিসেবে পালন করে। তিনি অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
স্বাগত বক্তব্যে প্রিয়লাল চাকমা বলেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, নৃশংস হত্যাকান্ড, ধরপাকড় ইত্যাদি অব্যাহতভাবে চলছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক। বর্তমানে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে সেনা অভিযান, নির্বিচারে ধর-পাকড়, ঘরবাড়ি তল্লাসি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদ করে মুসলিম সেটেলারদের বসতিদান ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনজাতিসমূহের রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তি আজ ২৮ বছর পরও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
ড. ইউনুসের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, দিঘীনালায় সেনা ও সেটেলারদের সম্মিলিত আক্রমনে আদিবাসী জুম্মদের উপর হামলা চালায়। এতে চারজন জুম্ম নিহত ও শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিরা হামলা চালায়। এতে সেনাবাহিনীর গুলিতে তিন জন জুম্ম যুবক নিহত হয় এবং পুলিশ ও সেনবাহিনীর উপস্থিতিতে জুম্মদের শতাধিক ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
পরিশেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুটিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে তুলে ধরার মাধ্যমে জনমত গঠন করা ও সারাবিশ্বে প্রচার ও জনমত গঠনের জোরদার করা; এবং জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করার প্রস্তাব তুলে ধরেন।