পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, পার্বত্য চুক্তি ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকায় দিনব্যাপী আলোচনা সভা

হিল ভয়েস, ৩১ মে ২০২৫, ঢাকা: আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর উদ্যোগে ঢাকায় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মিলনায়তনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, পার্বত্য চুক্তি ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে দিনব্যাপী এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

উক্ত আলোচনা সভায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠনের ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণসহ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম-সমন্বয়কারী জাকির হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন এর যুগ্ম-সমন্বয়কারী ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশ্লেষক এবং সাংবাদিক (দৈনিক প্রথম আলো) পার্থ শঙ্কর সাহা ।

আলোচনা সভার শুরুতে “ইতিহাসের আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম” এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন মানবাধিকার কর্মী ও যুগ্ম সমন্বয়কারী, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন জাকির হোসেন। এসময় তিনি মোগল শাসনামল থেকে বর্তমান বাংলাদেশ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেন।

ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী তার আলোচনায় তিনি ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম আদিবাসীদের জন্য নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপসমূহ নিয়ে কথা বলেন। ব্রিটিশ শাসনামলের নেওয়া একটা পদক্ষেপের ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটা সার্কেলে বিভক্ত করেছিল যেটি-মং সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও চাকমা সার্কেল নামে পরিচিত। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কয়েকটি জায়গা বর্তমানেও বিদ্যামান যেগুলো জেলা হিসেবে রাঙ্গামাটির জেলাধীন কিন্তু সার্কেল হিসেবে বোমাং সার্কেলের অধীনে পড়ে। তিনি বলেন, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বুঝতে গেলে ব্রিটিশদের প্রণীত আইন ও বিভিন্ন পদক্ষেপ তাদের শাসনামলের ইতিহাস বোঝাটা জরুরি। এভাবে তিনি ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনের নানান ঘটনাপ্রবাহ ও ইতিহাস তুলে ধরেন।

এরপরে পাকিস্তান শাসনামল নিয়ে তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম তৎকালীন পাকিস্তান শাসনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার একটি কারণ- চট্টগ্রাম বন্দরটি কর্ণফুলী নদীর উপর নির্ভরশীল, আর সেই নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে মিশেছে। তাই, চট্টগ্রাম বন্দরটি রাখতে হলে কোনো না কোনোভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখতেই হবে। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা শিল্প কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার অন্যতম একটি কারণ। যার ফলে ডুবে যায় ৫৪ হাজার একর জায়গা জমি যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট চাষযোগ্য জমির ৪০ ভাগ।

সর্বশেষ তিনি তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন তখন সম্ভব হবে যদি বাঙালি জাতি তাদের মনস্তত্ত্বের জায়গাকে পরিবর্তন করে। কারণ, আমরাই তো আদিবাসীদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখি। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশ্লেষক এবং দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক পার্থ শঙ্কর সাহা তার “পার্বত্য চুক্তি ১৯৯৭ এবং চুক্তি পরবর্তী বাস্তবতা ও বাস্তবায়ন” আলোচনায় বলেন, যখন পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছিল তখন একটা আনন্দময় পরিবেশ বিরাজ করছিল। কিন্ত এই চুক্তির পরের অবস্থা একটা সময় নতুন করে আবার সংঘাতের রূপ নেয়। আসলে চুক্তির আগের যে বাস্তবতা পাহাড়ে ছিল, তার থেকে আরো কঠিন বাস্তবতা বর্তমানে বিরাজ করছে, এখনো পাহাড়ে গেলে পরিচয়পত্র দেখিয়ে, অনুমতি নিয়ে, নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পার্বত্য চুক্তির অনেকগুলো বিষয় এখনো আদালতের কাঠগড়ায় বন্দী হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ কিন্তু একটি এককেন্দ্রিক সরকার, এই এককেন্দ্রিক সরকারকে ভাঙ্গার অন্যতম উপায় হচ্ছে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলন বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই ভিন্ন একটা মাত্রা যোগ করেছে।

তিনি আরো বলেন, এই পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে একটি কর্তৃপক্ষ ছিল বাংলাদেশ সরকার, কিন্তু সেই কর্তৃপক্ষই চুক্তিটা বাস্তবায়ন করছে না। যার ফলে নতুন সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে যা দেশের বৃহৎ স্বার্থের জন্য কখনো শুভকর হতে পারবে না।

সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে উপস্থিত অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গরা তাদের বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

More From Author