পার্বত্যাঞ্চলে এপিবিএনের নতুন ইউনিট চালু করায় সিএইচটি কমিশনের উদ্বেগ

0
787

হিল ভয়েস, ২৮ মে ২০২২, আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক: সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পসমূহে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর একটি নতুন ইউনিট চালু করছে জেনে ইন্টারন্যাশনাল সিএইচটি কমিশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিশনের বিশ্বাস এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সরাসরি লংঘন। চুক্তিতে শর্ত রয়েছে যে, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পসমূহ প্রত্যাহার করা হবে, কিন্তু সেই ক্যাম্পসমূহে এপিবিএন প্রতিস্থাপন করার ব্যাপারে কোনো কিছুই উল্লেখ নেই বলে জানান সিএইচটি কমিশন।

কমিশনের তিন কো-চেয়ার যথাক্রমে সুলতানা কামাল, এলসা স্টামাটোপোলো ও মিরনা কানিংহাম কেইনের স্বাক্ষরিত ২৮ মে ২০২২ তারিখের এক বিবৃতিতে সিএইচটি কমিশন এই উদ্বেগ প্রকাশ করে।

পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পসমূহে এপিবিএন মোতায়েনের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমূহ, ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহ, ও নাগরিক সমাজের মত প্রাসঙ্গিক ও সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে আলোচনা করা এবং অনতিবিলম্বে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ ও সময়সূচি ঘোষণা করাসহ অবিলম্বে চারটি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সিএইচটি কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ মে ২০২২ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এপিবিএন এর ক্যাম্প স্থাপনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাহৃত সেনা ক্যাম্পসমূহে এপিবিএন মোতায়েন করার সরকারের সিদ্ধান্তের পরপরই এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। এপিবিএন সদরদপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি’র পক্ষে পুলিশ সুপার (গোয়েন্দা) মোসাঃ সাদিরা খাতুন স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক এক সরকারি সার্কুলার (মেমো নং- এপিবি:স:দ:/গোয়েন্দা ২০২২/২৩০৬, তারিখ ১৩ এপ্রিল ২০২২) অনুসারে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাহৃত ২৪০টি সেনা ক্যাম্পে এপিবিএন মোতায়েন করবে। প্রথম ধাপে এ ধরনের ৩০টি পরিত্যক্ত ক্যাম্পে এপিবিএন মোতায়েন করা হবে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের এই সিদ্ধান্তে কমিশন বিস্মিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অবশিষ্ট অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহারের পরিবর্তে পরিত্যক্ত ক্যাম্পসমূহের জায়গায় এপিবিএন মোতায়েন করা হচ্ছে চুক্তির মূল অভিপ্রায়কে লংঘন করা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজির আহমেদ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীনের হুমকিমূলক বক্তব্যেও কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করে।

যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মেজর জেনারেল মোঃ সাইফুল আবেদীন তার বক্তব্যে বলেছেন, “তোমরা যদি যুদ্ধ করতে চাও…তাহলে একটি জায়গা ঠিক করো! ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা তোমাদেরকে শেষ করব।”

বিবৃতিতে বলা হয়, কমিশনের মতে উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে এই ধরনের বক্তব্য অগণতান্ত্রিক, অপেশাদারী এবং হুমকিমূলক। এটা জুম্ম জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক এবং বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক। এটা ইঙ্গিত করে যে, সরকার পার্বত্য সমস্যাটি রাজনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের পরিবর্তে পেশীশক্তি ও সহিংসতা দিয়ে সমাধান করতে চায়।

নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে এবং জুম্ম জনগণের অধিকারের আদায়ের আন্দোলনরত সংগঠন ও ব্যক্তিদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে অব্যাহতভাবে তকমা দিয়ে চলেছে তাতে কমিশন উদ্বিগ্ন। অথচ অভিযোগ রয়েছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে চলেছে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দুই রাজনৈতিক দল, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর কর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শন করে চলেছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সামনে ডিসেম্বরে চুক্তির ২৫ বছরপূর্তি হবে। সরকার চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কমিশন সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি একটি রাজনৈতিক, নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা নয়। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই সমস্যার রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা জরুরী।

কমিশন সরকারকে চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক প্রকার সামরিক শাসন ‘অপারেশন উত্তোরণ’ ও সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়।

কমিশন পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পূর্বের সেনা ক্যাম্পসমূহে এপিবিএন প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে পার্বত্য চুক্তি এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ অনুসারে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহে ‘পুলিশ (স্থানীয়)’ বিষয়টি হস্তান্তর এবং ‘পার্বত্য জেলা পুলিশ বাহিনী’ গঠনের সহযোগিতার জন্য সরকারকে আহ্বান জানায়।

পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পসমূহে অথবা অন্য কোনোখানে এপিবিএন মোতায়েনের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলসমূহ, ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠানসমূহ, ও নাগরিক সমাজের মত প্রাসঙ্গিক ও সংশ্লিষ্ট মহলের সাথে আলোচনা করার জন্য কমিশন সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

এছাড়া অচিরেই এবং স্বাধীনভাবে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগসমূহ তদন্ত করা এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা; বিচারবহির্ভূত হত্যা, হয়রানি, ভীতিপ্রদর্শন ও নির্বিচারে গ্রেপ্তার থেকে আদিবাসী অধিকারকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা; এবং অনতিবিলম্বে ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ ও সময়সূচি ঘোষণা করার জন্য কমিশন সরকারকে আহ্বান জানায়।