নৃশংসতা বন্ধ করতে শরণার্থী সংগঠন কর্তৃক সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান

0
827

হিল ভয়েস, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সব ধরনের নৃশংসতা বন্ধ করতে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কয়েকটি শরণার্থী সংগঠন। শরণার্থী সংগঠনগুলো ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিও জানিয়েছে।

প্রবাসী বঙ্গীয় সমাজ (দিল্লি-এনসিআর), অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট (কলকাতা) এবং অন্যান্য বাঙালি ও শরণার্থী সংগঠনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) নয়া দিল্লীস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সফররত প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করে এই দাবি জানানো হয়। ।

স্মারকলিপিতে প্রবাসী বঙ্গীয় সমাজের পক্ষে এ কে পাল এবং পদ্মনাভ লাহিড়ী এবং অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্টের পক্ষে ড. মোহিত রায় এবং সুজিত শিকদার স্বাক্ষর করেন।

স্মারকলিপিতে শরণার্থী সংগঠনগুলি ৬টি দাবি উত্থাপন করে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- (১) হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর সব ধরনের অত্যাচার বন্ধ করা; (২) সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল অপরাধীকে গ্রেফতার ও শাস্তি বিধান করা; (৩) সাজানো ধর্মী‍য় অবমাননা মামলার নামে হিন্দুদের হয়রানি বন্ধ করা; (৪) সকল হিন্দু শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সমস্ত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা; (৫) অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা এবং (৬) ইসলামিক ওয়াজ ও মাহফিলে হিন্দুবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা।

স্মারকলিপিতে শরণার্থী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর অব্যাহত অত্যাচার বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আশ্বাস দাবি করা হয়। শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে স্মারকলিপিতে বলা হয়, “আপনি এমন সময়ে সফরে এসেছেন যখন সবে শুরু হয়েছে হিন্দু বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার মৌসুম। আর যথারীতি হিন্দু দেব-দেবী ও মন্দিরের হামলা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দু ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলার ঘটনা নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে মন্দিরে হামলা, মূর্তি ভাঙ্গা (প্রতিমা), মন্দির ও শ্মশান ভূমি জোরপূর্বক দখল করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং প্রতি বছর সারা বছরই ঘটে থাকে।

স্মারকলিপিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে এই ঘটনার রিপোর্ট প্রায়ই স্থানীয় মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়, কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে। কিন্তু কিছুই হয় না। চক্রাকারে পুনরাবৃত্তি ঘটে, বিশেষ করে দুর্গা প্রতিমার (প্রতিমা) উপর আক্রমণ প্রতি বছরই দুর্গাপূজার কয়েক মাস আগে শুরু হয় এবং এটি একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে।

গত বছর ২০২১ সালের দুর্গাপূজা উৎসব চলাকালীন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সাম্প্রদায়িক হামলার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছিল। মহাষ্টমীর দিন (১৩ অক্টোবর) থেকে ০১ নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৭টি জেলায় ১৭টি মন্দির,পূজা মণ্ডপ, ৩০১টি, বসতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর হামলাসহ সর্বমোট ৫ জন নিহত হয়েছে।

স্মারকলিপিতে আরও যোগ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত নয় বছরে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ৩,৬৭৯ টি হামলা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে ১,৫৫৯টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এই সময়কালে ৪৪২টি হিন্দু ব্যবসার উপর আক্রমণ, ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রতিমা, পূজা প্যান্ডেল ও মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ১,৬৭৮টি। আসকের হিসাব মতে, হামলায় ৮৬২ জন হিন্দু আহত হয়েছে এবং ১১ জন নিহত হয়েছে। এখন পূজার মরসুম আসছে এবং এরই মধ্যে দুর্গা প্রতিমা ভাংচুর করার অনেক ঘটনা ঘটেছে।

মাইনরিটি রাইটস গ্রুপের মতে, বাংলাদেশে গত ছয় মাসে ৭৯ জনের মতো হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। শুধুমাত্র গত ছয় মাসে হিন্দুদের ওপর ৫০১টি সংবদ্ধ হামলা, ৫৬টি মন্দিরে হামলা এবং ৫০টি প্রতিমা চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দেশে ১৩ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যকে ধর্ষণ, ১০ জন গণধর্ষণ, তিনজনকে ধর্ষণের পর হত্যা, ১৯ জন ধর্ষণের চেষ্টা, ৯৫ জনকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা, ২১ জনকে ধর্মান্তরের চেষ্টা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে।

হিন্দু শিক্ষকদের গলায় জুতার মালা দিয়ে মারধর ও হয়রানি করা হচ্ছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, সাভারসহ বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ঘটনা ঘটছে অবিরাম। বাংলাদেশ সরকার শুধু নীরব দর্শক হয়েই রয়ে গেছে। এমনকি গত ৫০ বছরে মুসলমানদের দ্বারা সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায় পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার কোন দোষীকে শাস্তি বিধান করা হয়নি।

স্মারকলিপিতে আরো বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় বৌদ্ধ চাকমা সম্প্রদায়কেও অব্যাহতভাবে হয়রানি, হামলা ও ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আদমশুমারি দেখায় যে, হিন্দু জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

শরণার্থী সংগঠনগুলো শেখ হাসিনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্যের রক্ত এবং ২৫ লাখ বাঙালি হিন্দুর প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের ৬টি দাবি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে জোর দাবি জানাচ্ছেন।