নাথান বম ও শামীম মাহফুজ সমঝোতা সংলাপে প্রথম মিলিত হন কক্সবাজারে

0
457
ছবি: নাথান বম (বামে) ও শামীম মাহফুজ (ডানে)

হিল ভয়েস, ২৮ অক্টোবর ২০২২, বিশেষ প্রতিবেদক: ইসলামী জঙ্গী নেতা শামীম মাহফুজ ও বমপার্টির নেতা নাথান বম প্রথম সমঝোতা সংলাপে মিলিত হন ২০১৯ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে। ইসলামী জঙ্গীদের পক্ষে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাহফুজ, রক্সি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করা মহসীন ওরফে রিয়েল এবং বিকাশ ও তমাল। আর বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের পক্ষ থেকে বৈঠকে ছিলেন নাথান বম ও তার দুই সহযোগী। বৈঠকে প্রশিক্ষণের যাবতীয় খরচ ও অস্ত্রের জোগান দেওয়ার আশ্বাস দেন মাহফুজ।

গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) ঢাকার মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ইসলামী জঙ্গী সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার উদ্দেশ্য ছিল সাংগঠনিক কাজে বাধা পেলে পাল্টা আঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করা। এজন্য নিরাপদ জায়গা হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর আদলে অত্যাধুনিক কমান্ডো গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়, যারা দেশের অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর ব্যাকআপ টিম হিসেবে কাজ করবে।

অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান আরো বলেন, নিরাপদে সশস্ত্র অপারেশনে অংশ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে ফিরে যাবে তারা। বর্তমানে কমান্ডো টিমের প্রশিক্ষণে এয়ারগান, শটগান ও হালকা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হলেও দ্রুতই আসার কথা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রের একটি চালান। আল-কায়েদার অনুসারী নতুন এ জঙ্গি সংগঠনটি এখনো সাংগঠনিকভাবে কোনো অপারেশনাল কার্যক্রমে না গেলেও সক্ষমতা অর্জনের পর উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠায় অপারেশন পরিচালনার কথা রয়েছে।

এদিকে বুধবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ডেমরা থেকে শারক্বীয়ার পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। তারা হলেন- নাটোরের আবদুল্লাহ, কুমিল্লার চান্দিনার তাজুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের জিয়াউদ্দিন ও মাহামুদুল হাসান এবং মাদারীপুরের হাবিবুল্লাহ। তাদের থেকে তিনটি মোবাইল ফোন ও ফতোয়া-সংক্রান্ত ১২ পাতা কাগজ জব্দ করা হয়েছে।

সিটিটিসি সূত্র জানান, হিজরতকারীদের ক্যাম্পে নিয়ে তিন ভাগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রথম ধাপে পাহাড়ের ক্যাম্পে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধকৌশল ডামি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। শেষ ধাপে পেট্রোলিং শেখানো হতো। সংগঠনটির নেতৃত্ব দেওয়া শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিষিদ্ধ জামাআতুল মুসলিমিনের (জেএম) মাধ্যমে জঙ্গিবাদে নাম লেখান। শুরু থেকেই তার টার্গেট ছিল ভিন্ন ধরনের একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করা। কিন্তু ২০১১ সালে জঙ্গি সংগঠনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

এরপর ২০১৪ সালে পৃথক আরেকটি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান মাহফুজ। মূলত ওই সময়ই তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি হুজির সদস্য মাওলানা আবু সাঈদ ও একিউআইএসের প্রধান সমন্বয়কারী মুফতি মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সির সঙ্গে দেখা করতে সক্ষম হন। কারাগারে থাকতেই রক্সি আশ্বস্ত করেন তার সংগঠনের শুরা সদস্যদের এ সংগঠনে যুক্ত করে দিতে পারবেন।

সে আলোচনা মোতাবেক ২০১৭ সালে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে হেডকোয়ার্টার বান্দরবানে করার সিদ্ধান্ত নেন মাহফুজ। পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে অনুধাবন করে পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করেন। কেএনএফের নেতৃত্বে ছিলেন নাথান বম। এরই মধ্যে নাথান বম ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন। এরপর খোঁজ নিয়ে মাহফুজ জানতে পারেন কেএনএফের নেতৃত্বে থাকা এই নাথান বম ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও তার একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

জানা গেছে যে, আনসার হাউস (শেল্টার হোম) পরিচালনা করতেন গ্রেফতারকৃত আবদুল্লাহ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য হিজরতের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেত তাদের এই আনসার হাউসে জায়গা দেওয়া হতো। পরে সেই আনসার হাউস থেকে আবদুল্লাহ এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে পাঠাতেন। এ ছাড়া গ্রেফতার তাজুল ও হাবিবুল্লাহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের যেসব সদস্য আনসার হাউসে আসতেন তাদের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসতেন।

শাকের বিন ওয়ালী হচ্ছেন এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান। শাকের বিন ওয়ালী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস করেছেন। তিনি জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি আরেক হুজুরের নির্দেশে তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতেন। চিকিৎসা দিতে এই শাকের বিন ওয়ালী প্রতি মাসে একবার বান্দরবানে নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতেন। এ ছাড়া জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের সদস্যরা আহত হলেও সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিতেন ডাক্তার শাকের বিন ওয়ালী।

উল্লেখ্য যে, রেইংখ্যং ভ্যালীতে যৌথবাহিনীর কম্বিং অপারেশনের সময় গত ১২ অক্টোবর ২০২২ বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়ায় “সাংগঠনিক কাজে বাধা পেলে পাল্টা আঘাত করার পরিকল্পনা” মোতাবেক জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গী সদস্যরা বমপার্টির সশস্ত্র সন্ত্রাসী সদস্যদের নিয়ে সেনাবাহিনীর উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিল।

আরো উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে ভন্ডুল করা এবং জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তথা জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবাহিনী কর্তৃক পৃষ্টপোষকতা ও আশ্রয় প্রদানকারী বিভিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের পর সর্বশেষ সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ হচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), যা বম পার্টি নামে সমধিক পরিচিত। বমপার্টি প্রতিষ্ঠার গোড়া থেকেই রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দুধকলা দিয়ে গড়ে তোলা সেই বমপার্টিই আজ বুমেরাং হয়ে ইসলামী জঙ্গীদেরতে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে এবং ইসলামী জঙ্গীদের সহযোগে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপর সশস্ত্র হামলায় সামিল হচ্ছে।

উল্লেখ্য, নাথান বম ও শামীম মাহফুজের সমঝোতা সংলাপের ফলশ্রুতিতে বম পার্টি ও ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে ২০২১ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত চুক্তি অনুযায়ী, বম পার্টি কর্তৃক ইসলামী জঙ্গী সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ অন্যান্য বাবদ ইসলামী জঙ্গীরা বম পার্টিকে মাসিক ৩০ লাখ টাকা দিয়ে থাকে। তারই অংশ হিসেবে গত ৪ অক্টোবর ২০২২ নাথান বম ইসলামী ব্যাংকের লোহাগাড়া শাখা থেকে ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন।