দীর্ঘ সময় ধরে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া হতাশাজনক: চট্টগ্রামে চুক্তির বর্ষপূর্তি সভায় বক্তারা

0
454

হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: দীর্ঘ সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াটা অত্যন্ত হতাশাজনক বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে চট্টগ্রামে চুক্তির বর্ষপূতি সভার বক্তারা। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের দাবিতে চট্টগ্রামে আলোচনা সভা ও গণসংগীত পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় নগরের জেএমসেন হল প্রাঙ্গনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক তাপস হোড়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন একুশে পদক প্রাপ্ত লেখক, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোসাইন কবির, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান, ঐক্য ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদক পাহাড়ি ভট্টাচার্য্, চট্টগ্রাম চেম্বার এন্ড কমার্সের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্র্টির সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক সুমী খান, নারী নেত্রী এ্যাড. রেহেনা বেগম রানু, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. নিতাই প্রসাদ ঘোষ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য হ্লামিউ মারমা। অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন পিসিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণ চাকমা এবং পাহাড়ী শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল চাকমা।

অনুষ্ঠানে গণসংগীত পরিবেশনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত বক্তব্য রাখেন লেখক, কবি ও সাংবাদিক জনাব আবুল আবুল মোমেন বলেন, “২৪বছর পূর্বে আমরা আশা করেছিলাম এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেটি এখনও অধরা রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী মহলের মাঝে আদিবাসীদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক কোন পদক্ষেপ ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা কিংবা ১৯০০ সালের বিধি অনুযায়ী অধিকার দেওয়ার কথা ছিল সেটিও দেয়া হচ্ছে না কিংবা তা কেন দেয়া হচ্ছে না সেটিও জানা হলো না।

তিনি আরো বলেন, আজকে বলা হচ্ছে পাহাড়ে আদিবাসীরা জুম চাষের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করছে, তা কিন্তু ঠিক না। আদিবাসী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আন্তর্জাতিক যে সনদগুলো রয়েছে সেই সনদে পরিবেশের কথা বলা হয়েছে এবং আদিবাসীদের তাদের জীবনযাপনের প্রক্রিয়ায় সেটি করছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের সংস্কৃতি রক্ষা করতে হলে ভাষাভিত্তিক সাহিত্যের বিকাশ ঘটাতে হবে, না হলে বাংলাভাষীর সংস্কৃতির সাথে হারিয়ে যেতে হবে। লেখাপড়া, জ্ঞানচর্চা মাতৃভাষায় করতে হবে, মানসম্মত সাহিত্য মাতৃভাষায় চর্চা করতে হবে। পার্বত্য চুক্তিতে যে প্রতিশ্রুতিতে ছিলো বিশেষ করে ভূমি কমিশন ও প্রশাসন সেগুলোকেও যথাযথভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে। ঐক্যের ভিত্তিতে দাবি আদায় করতে হবে। বিভাজনগুলো দূর করে কীভাবে ঐক্যের জায়গা বড় করা যায় সেটি ভাবতে হবে।আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায় হবে না। আন্দোলনের ফসল যাতে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায় সেটিও ভাবতে হবে।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক হোসাইন কবির বলেন, “পাহাড়ে যে সংগ্রাম হয়েছে, সেটি মানুষ হিসেবে আমারও সংগ্রাম হিসেবে মনে করি। কাপ্তাই বাঁধের ফলে তারা যে ভূমি হারিয়েছে সেটির ক্ষতিপূরণ কিন্তু তারা পায়নি। আজকে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীকে বছর বছর ধরে অধিকারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। সেখানে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য সেখানে চুক্তি হয়েছে তার জন্য রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানাই কিন্তু চুক্তির তো বাস্তবায়ন হয়নি। আপনি তাদেরকে যে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলেন সেটি তো আপনি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সাথে বলেন সেটিতো উচিত নয়, সেটি তাদের প্রতি অবমাননাকর। আপনি যখন নির্দিষ্ট আদর্শ রেখে রাষ্ট্র চালাবেন তখন কিন্তু অন্য আদর্শ সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে , যা আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকল জনগণের অধিকার রক্ষা করা,নির্দিষ্ট কোন ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করা না। আজকে পান থেকে চুন খসে পড়লে ৫৭ ধারার ভয় দেখান, ধর্মীয় অবমাননার ভয় দেখান। আজকে রাষ্ট্র নির্দিষ্ট একটা ধর্মকে প্রাধান্য প্রদান করছে সেটি তো রাষ্ট্রের করার কথা ছিল না।”

কবি ও সাংবাদিক জনাব হাফিজ রশিদ খান বলেন, “পাহাড়ের সন্তানগুলো স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। আমরা দেখেছি আশির দশক থেকে আতঙ্ক কিংবা উত্তেজনার পরিবেশ সেখানে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সেটি করেছে রাষ্ট্র। সেখানে সেটেলার বাঙালি নিয়ে যাওয়া হয়েছে যাদেরকে সরকার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। যখন সেটেলার বাঙালির প্রশ্নের সম্মুখীন হই তখন আমরা বিভক্ত হয়ে যায়।

চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে যখন আসে তখন একপক্ষ বলছে মাত্র কয়েকটি বিষয় বাস্তবায়ন হয়েছে আর অপরপক্ষ বলছে বেশিরভাগ অংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। এই বিষয়টি আমাদেরকে বিশ্লেষণ করতে হবে। আজকে আমরা যে দোষারোপের রাজনীতি দেখতে পাচ্ছি সেটি বন্ধ করে চুক্তি বাস্তবায়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”

সাংবাদিক সুমী খান, “একজন মানুষও যদি নিপীড়িত থাকে, একজন মানুষও যদি অধিকার বঞ্চিত থাকে- আমি তাদের পক্ষে কথা বলে যাবো। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক পাহাড়ে যে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে সেই বর্বরতার ইতিহাস সবাই জানে। হ্যাঁ বর্ডার এলাকায় নিরাপত্তা দরকার কিন্তু সেটি ভূমিপুত্রদের নিপীড়ন করার জন্য নয়, কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করার জন্য নয়। আজকে চুক্তির ২৪টি বছর পর সেখানে আদিবাসীরা ভূমি অধিকার হারাবে? আমি বান্দরবানে দেখেছি সেখানে আদিবাসীদেরকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, আদিবাসীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আদিবাসীদের ভূমিতে মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে, কেন তাদের ভূমিতে মসজিদ করা হচ্ছে?”

এ্যাড. রেহেনা বেগম রানু “আমি মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও সত্য যে, শান্তিচুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়নের আদিবাসীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে, রক্ত ঝরাতে হচ্ছে, সেই সাথে যারা আমরা সচেতন মানুষ আমাদেরও রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। আমি প্রশ্ন রাখতে চাই- আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশন কেন কাজ করবে না? যখন আদিবাসীদের অধিকার ফিরে পাবে তখনই কেবল টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে।”

এ্যাড. নিতাই প্রসাদ ঘোষ “১৩ বছর ধরে যে সরকার ক্ষমতায় তার বুঝা উচিত ছিল যাতে চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। আমি করে করি উন্নয়নের যে রোল মডেল সেটি কোন একটা জাতিগোষ্ঠীকে পিছনে রেখে সম্ভব নয়। আপনাদের বুঝতে হবে পাহাড়ে যে নির্যাতন চলছে তা সমতলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপরও সমানভাবে চলছে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে অধিকারহারা মানুষজন লড়াই করতে না পারি তাহলে আমরা অধিকার পাবো না।”

মাহফুজুল হক শাহ, “এই দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই অধিকার পাবে- এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার জন্য পাহাড়ীদের মধ্যে যে হতাশা সেটি দূর করা সরকারের দায়িত্ব। মনের যে অশান্তি সেটি অনেক সময় অর্থনৈতিক সাবলম্বী দিয়ে দূর করা যায় না।”

অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, “শান্তি চুক্তি হওয়াটা সেই সময়ে আমাদের দেশের জন্য গৌরবোজ্জল উদাহরণ ছিল। কিন্তু চুক্তির ২৪বছর পরও কয়েকটি মৌলিক বিষয় বাস্তবায়ন হয়নি যা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় বিশেষ করে যে সরকার চুক্তি করেছে সেটি বর্তমানে ১৩ বছর ক্ষমতার থাকার পরও। স্বাধীনতার পরও পাহাড়ী জনগণকে ২২টি বছর রক্ত ঝরাতে হয়েছে তাদের অধিকারের জন্য। আমার আজকের সমাবেশ থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে চাই, চুক্তির যে ধারাগুলো বাস্তবায়ন হয়নি সেটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হোক।”

ঐক্য ন্যাপের  পাহাড়ি ভট্টাচার্য বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল পাহাড়ি-বাঙালি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিমসহ কোন ধরণের ধর্মীয় ও জাতীয়গত বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ ভয়ের বাসা বেঁধেছে। আজ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল না।

সারা পৃথিবীতে ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিটি প্রশংসিত হলেও আজ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি, সেখানে সেনাক্যাম্প বেড়েছে, ভূমি বেদখল বেড়েছে। সেখানে জুম চাষের উপর আঘাত, কৃষি ক্ষেত্রে আঘাত এসেছে। যা চুক্তির পুরোপুরি লঙ্ঘন। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আদিবাসীরা যাতে মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য আদিবাসীদের মধ্যে ঐক্য চাই, সুশীল সমাজের মধ্যে ঐক্য চাই, পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে ঐক্য চাই।”

হ্লামিউ মারমা, ‘২৪টি বছর পূর্বে বহু আশা নিয়ে পার্বত্যবাসী চুক্তি করেছিল। কিন্তু এতবছর পরও সেই শান্তি চুক্তির স্বাদ আমরা পাচ্ছি না বন্ধুগণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটির জন্য কারা দায়ী? চুক্তিকে অস্বীকার সেখানকার ডেপুটি কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সব বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আনাচে-কানাচে যে সেনাক্যাম্প সেটি পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে চুক্তির পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও বর্তমান পরিস্থিতি প্রায়ই একই হয়ে যাচ্ছে।’