দীঘিনালার মাইনী ভ্যালীর দুর্গম এলাকায় ১০ই নভেম্বর পালিত

হিল ভয়েস, ১১ নভেম্বর ২০২৫, খাগড়াছড়ি: গতকাল সোমবার (১০ নভেম্বর) খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা উপজেলার বাবুছড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত মাইনি ভ্যালীর দুর্গম এলাকায় জনসাধারণের উদ্যোগে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী ও জুম্ম জাতীয় শোক দিবস-২০২৫ উপলক্ষে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও স্মরণ সভা আয়োজন করা হয়।

উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ৫ নং বাবুছড়া ইউনিয়নের সম্মানিত চেয়ারম্যান গগণ বিকাশ চাকমা, ডুলুছড়ি ৩৫ নং মৌজা হেডম্যান সূর্য বিজয় তালুকদার, কুকিছড়া ৩৬ নং মৌজা হেডম্যান শান্তি কুমার চাকমা, সৌদ্দেংছড়া ৩৭ নং মৌজা হেডম্যান অলঙ্গ ভূষণ দেওয়ান, মহিলা মেম্বার প্রতিভা চাকমা, নাড়াইছড়ি জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নান্টু চাকমা, বাবুছড়ার প্রাক্তন মেম্বার ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মেরিন চাকমাসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত প্রায় ৮০০ জন স্থানীয় কার্বারি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ওয়ার্ড মেম্বার এবং স্থানীয় জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।


সকাল ৭:৩০ টার সময়ে গণজমায়েত ও কালো ব্যাস ধারণ করে সকাল ৮ টায় অস্থায়ী শহীদ বেদীতে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদার সাথে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়।

সকাল ৯ টায় স্মরণ সভার আলোচনার শুরুতে শোক প্রস্তাবসহ শহীদের সম্মান জানিয়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আয়োজিত সভায় স্বাগত বক্তব্যে প্রদান করেন দোজর এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত সভাপতি পদ্মলাল চাকমা।

তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় পরে এ দুর্গম এলাকায় আমরা সকলের আন্তরিক সহযোগিতায় মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মৃত্যবার্ষিকী উদযাপন করছি। এত জনসমাগম অতীতে উক্ত এলাকায় কোনোদিন সম্ভব হয়নি। এম এন লারমা জুম্ম জাতির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার দেখানো পথ ধরে আমরা এখনো সংগ্রামে রত রয়েছি। পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলের মানুষ ১০ই নভেম্বর এর তাৎপর্য বিষয়ে তেমন জানে না। আজকে সে সুযোগ এবং উপলব্ধি নিশ্চয় তাদের মনে করিয়ে দিবে।

এরপর ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ১০ ই নভেম্বর’৮৩ স্বরণে তিনটা কবিতা আবৃতি পাঠ করা হয়।

প্রাক্তন মেম্বার ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মেরিন চাকমা বলেন, মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বিষয়ে সকলের জানা থাকা প্রয়োজন। গোটা বিশ্বের জুম্ম জনগণ আজকের এই দিনটাকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। ১০ই নভেম্বর দিনে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত হামলায় মহান নেতাকে হত্যার ঘটনা জাতির জন্য ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা।

স্কুল শিক্ষিকা হ্যাপী চাকমা বলেন, এম এন লারমা জুম্ম জাতির পিতা তা আমরা সবাই জানি। ছাত্র-যুব সমাজ দেশ ও জাতির জন্য কাজ করার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা একদিন নিশ্চয় নিজেদের অধিকার ফিরে পাবো। এজন্য শিক্ষাকে ধারণ করতে হবে। দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

স্মরণ সভায় নাড়াইছড়ি জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক নান্টু চাকমা বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে স্মরণ করা মানে তার দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চলা। দীর্ঘ বছর পর দুর্গম এ এলাকায় আমরা সমবেত হয়ে আমরা ১০ই নভেম্বর দিনটি পালন করছি। আজকে যার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রয়েছে তারাও জানবে আমাদের মহান নেতার সংগ্রামী পথচলা। তরুণ ছাত্র-যুব সমাজকে এম এন লারমার শিক্ষা কি তা জেনে নিতে হবে। শিক্ষার সুযোগকে ধারালো করার পাশাপাশি অভিভাবক সমাজকে ও নিজেদের সন্তানদের সে শিক্ষা দিতে হবে।

ওয়ার্ড মেম্বার প্রতিভা চাকমা তার আলোচনায় বলেন, অধিকার পাওয়া নিশ্চয় সহজ বিষয় নয়। এম এন লারমা দেখিয়ে যাওয়া পথ ধরে আমরা যদি একসঙ্গে চলতে পারি তাহলে একদিন অধিকার ও অস্তিত্ব নিয়ে আমরা বেঁচে থাকতে পারবো। এলাকায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজের জন্য কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে।

স্মরণ সভার অন্যতম আলোচক বাবুছড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গগণ বিকাশ চাকমা বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট তা আমাদের জন্য অনুকূলে নয়। আজকে সেনাশাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আজ জনপ্রতিনিধি হয়েও সাধারণ মানুষের ন্যায্য যে সুযোগ ও অধিকারগুলো ঠিক মতো দিতে পারছি না। আমাদের নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। ভাগ করো শাসন করো নীতিতে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভাজিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র শাসক কর্তৃক আমাদের জুম্ম জাতিকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার যে কৌশল তা একমাত্র মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই তিনি সে সময়কার সংসদে দাঁড়িয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন, তা আজ আমাদের শিক্ষা দেয়।

তিনি আরো বলেন, বাবুছড়া ইউনিয়নের প্রায় ১৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৬ টি স্কুল রেজিস্ট্রি করা, শিক্ষকরা বর্গা দিয়ে সে স্কুলগুলো চালাচ্ছে। সেজন্য অভিবাবক মহল থেকেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে তালা ঝুলাতে হবে। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তা আমাদের বুঝতে হবে এবং শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আজকে ১০ই নভেম্বরের দিনে দুর্গম এলাকায় সর্বস্তরের মানুষ আমরা একত্রিত হয়েছি, তা অত্যন্ত সৌভাগ্য। আমাদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রতি আমাদের সচেতনতা ও জরুরী। আগামীতেও ১০ই নভেম্বর যাতে আরো সকলের অংশগ্রহণে আমরা পালন করতে পারি সেজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি ব্যক্ত করেন।

এছাড়াও মৌজার হেডম্যান প্রতিনিধিরাও উক্ত স্মরণ সভায় সংক্ষিপ্তভাবে বক্তব্য প্রদান করে এবং সন্ধ্যা ৫ টার সময়ে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে সমাপ্ত করা হয়।

More From Author