ত্রিপুরা রাজ্য জুড়ে মহারাজা বীর বিক্রমের ১১২তম জন্মজয়ন্তী পালিত

0
1217
ছবি: দৈনিক সংবাদ

হিল ভয়েস, ২০ গস্ট ২০২০, গরতলা: গতকাল ১৯ আগস্ট ২০২০ বুধবার আগরতলার বেণুবন বিহারে ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের ১১২তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠিত হয়।

বুধবার গোটা রাজ্যজুড়ে নানা আয়োজনে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয় তার ১১২তম জন্মজয়ন্তী। যে অর্থে বলতে গেলে এবারই প্রথম গোটা রাজ্যজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, এমনকি সরকারী স্তরে পালিত হয়েছে বীর বিক্রমের জন্মদিন।

আগরতলাস্থ বেণুবন বিহারে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্যের প্রতিকৃতির পাদদেশে ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব। উক্ত অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন উপ মুখ্যমন্ত্রী যিষ্ণু দেববর্মা, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের সচিব শৈণেন্দ্র সিং, পরিচালক রতন বিশ্বাস ও অন্যান্য গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ও আধিকারিকবৃন্দ।

উক্ত অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব বলেন, ‘আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার’ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর। তাকে আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার হিসাবে এমনি এমনি আখ্যায়িত করা হয়নি। তার কর্মকাল, কর্মপদ্ধতি ত্রিপুরার সার্বিক উন্নয়নে যে নিদর্শন ও ছাপ রেখে গেছে, তা থেকে স্পষ্ট মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর আধুনিক ও উন্নত ত্রিপুরা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন।

তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পর ত্রিপুরার রাজ পরিবার ও রাজারা পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসে। বিশেষ করে মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরকে যোগ্য সম্মান জানানো হয়।

বীর বিক্রমের স্মৃতিতে আগরতলা বিমানবন্দর নামকরণ করা হয়। বিমানবন্দরে বসানো হয় বীর বিক্রমের বিশাল মুর্তি। সেই মুর্তির আররণ উন্মোচন করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯ আগস্ট বীর বিক্রমের জন্মদিনকে সরকারী ছুটি হিসাবে ঘোষণা করে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।

এখানেই শেষ নয়, মহারাজা বীর বিক্রম আধুনিক ত্রিপরা গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে পাথেয় করে ‘এক ত্রিপুরা শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা’ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে বর্তমান বিজেপি-আইপিএফটি সরকার কাজ করে চলেছে বলে জানার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব।

এদিকে ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (এডিসি)-এর উদ্যোগে খুমুলুঙস্থিত পরিষদের মূল প্রশাসনিক ভবন প্রাঙ্গণে মহারাজা বীর বিক্রমের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়। প্রদীপ প্রজ্বলন ও বীর বিক্রমের প্রতিকৃকিতে মাল্যদানের মাধ্যমে এর সূচনা করেন অতিরিক্ত মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক উষারঞ্জন দেববর্মা। অংশ নেন অন্য আধিকারিক-কর্মীরাও। শ্রী দেববর্মা আলোচনায় অংশ নিয়ে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরকে আধুনিক ত্রিপুরার রীপকার হিসেবে উল্লেখ করেন।

এছাড়া খয়েরপুরের ধুপছড়া এডিসি ভিলেজে, বিকাল তিনটায় মহারাজা বীর বিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে, ত্রিপুরা উপজাতি কর্মচারী সমিতি (টিইউজেএস) এর উদ্যোগে আগরতলা মহরের প্রাণকেন্দ্র রাজবাড়ি উজ্জয়ন্ত প্রসাদের মূল ফটকে, চড়িলাম বিধানসভা এলাকা, কংগ্রেসের উদ্যোগ টাকারজলায় মহারাজা বীর বিক্রমের জন্মবার্ষিকী পালন করা হয়।

এসপি ত্রিপুরা নামে একজন ব্যক্তি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে উল্লেখ করেন যে, স্বাধীন ত্রিপুরার ১৮৪ তম রাজা ও আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার বীর বিক্রম মানিক্য বাহাদুর ১৯৪৭ সালের ১৭ মে ৩৯ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল ছিল মহারাজার জন্মদিবস। তিনি ১৯০৮ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য একজন প্রজাবৎসল, শিক্ষানুরাগী, জ্ঞানী ও দুরদর্শী রাজা ছিলেন। তাঁর আমলে আধুনিক ত্রিপুরা রূপায়ণের কাজ শুরু হয়। স্বাধীন ত্রিপুরাকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি উন্নয়ন, সুশাসন, সামরিক, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় সফর করেন। তিনি ১৯৩১-১৯৩৯ সাল ৮ বছরব্যাপী ইউরোপ ও আমেরিকায় সফর করে বহুবিধ জ্ঞান অর্জন করেন। এসময়ে তিনি বৃটিশ, ইতালী, জার্মানী ও আমেরিকার রাষ্ট্র প্রধান কর্তৃক সম্বর্ধিত হয়েছিলেন।

মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য আধুনিক ত্রিপুরা রূপায়ণের লক্ষে রাষ্ট্রে শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি দু’বছরে ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে যারা ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসন ও সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব প্রদান করছেন তাঁদের বেশীরভাগই এই কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারেও উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য নগর উন্নয়নসহ রাজ্যের রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ রাজ্যের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বহি:রাষ্ট্রের সাথে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সিভিল প্রশাসনকে শক্তিশালী করার লক্ষে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের আদলে ‘ত্রিপুরা সিভিল সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্যে তিনি আধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে ত্রিপুরা রাইফেলস বাহিনী গড়ে তোলেন। এই ত্রিপুরা রাইফেলস বৃটিশ সরকারের অনুরোধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির পক্ষে অংশগ্রহণ করে এবং বার্মায় জাপানের সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য বৃটিশ সামরিক প্রধান ত্রিপুরা রাইফেলসকে পুরস্কৃত করেন। ত্রিপুরা রাইফেলস- এর জন্য এটি ছিল এক বড় মাপের গর্ব ও সম্মানের বিষয়।

মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য প্রজাসাধারণের কল্যাণার্থে বিশেষত: ত্রিপুরার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে ১১০০ একর রিজার্ভ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের মোট ভূমির ৫০ ভাগ ভূমি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য রিজার্ভ ঘোষণা করেন। তিনি আধুনিক ত্রিপুরা রূপায়নের অংশ হিসেবে রাজ্যের তেল, কয়লা ও গ্যাস উত্তোলনের লক্ষে জিওগ্রাফিক্যাল সার্ভে সম্পন্ন করেন। মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য রুদ্রসাগর নামক ৭ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ লেকের মধ্যখানে ‘নীড়মহল’ নামে এক মনোমুগ্ধকর রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন, যা পৃথিবীতে অতি বিরল।

মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্য বাহাদুর ১৯২৩ সালে ১৬ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি মারা যান ১৯৪৭ সালে মাত্র ৩৯বছর বয়সে। তিনি অতি অল্প বয়সে মারা যান। এটি ছিল- ত্রিপুরাবাসীর এক অপূরনীয় ক্ষতি। তিনি যদি দীর্ঘ সময় ত্রিপুরাকে শাসন করার সুযোগ পেতেন তাহলে ত্রিপুরার চিত্র অন্যরকম হতো। তিনি রাজ্যের শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি তথা ত্রিপুরার সামগ্রিক উন্নয়ন উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারতেন। তথাপি অল্প সময়ে ত্রিপুরার সামগ্রিক উন্নয়নে তিনি যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তা ত্রিপুরাবাসী আজীবন মনে রাখবে।

মহারাজা বীর বিক্রম মানক্য বাহাদুরের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিজেপি সরকার আগরতলা বিমানবন্দরকে ‘বীর বিক্রম মানিক্য বিমানবন্দর’ নামে নামাঙ্কিত করেছে এবং মহারাজার জন্মদিবস ১৯ আগস্টকে সরকারী ছুটি হিসেবে ঘোষণা করেছে। ত্রিপুরা সরকার প্রতিবছর মহারাজার জন্মদিবস ১৯ আগস্টকে সরকারীভাবে পালন করছে। পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও মহারাজার জন্মদিবস উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত পালন করে থাকে। মহারাজার জন্মদিবসটি বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরাও পালন করে থাকে বলে এসপি ত্রিপুরা উল্লেখ করেন।