তরুণ প্রজন্মকে ড. আর এস দেওয়ানের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবেঃ রাজা দেবাশীষ রায়

0
948

হিল ভয়েস, ২৬ আগস্ট ২০২২, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটিতে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২২ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চাকমা সার্কেলের চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘তরুণ প্রজন্মকে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের (আর এস দেওয়ান) জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্য হোক যারা মানুষের অধিকারের জন্য কাজ করেন তাদের ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো।’

আজ ২৬ আগস্ট ২০২২ বিকাল ৩:০০ টায় রাঙ্গামাটি শহরের রাঙ্গাপানি এলাকাস্থ কান্ত স্মৃতি ফুটবল মাঠে এই ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল চীফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়। এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা (অব:উপ-সচিব), এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সৌখিন চাকমা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠক শিশির চাকমাসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২২ এর আহ্বায়ক জুয়েল চাকমা। উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে জানা গেছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর রাঙ্গাপানি, মোনঘর এর শিক্ষার্থীরা মনোমুগ্ধকর ডিসপ্লে প্রদর্শন করেন।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় আরও বলেন, ‘তাঁর কাজের জন্য কিছু আর্থিক যোগান দেওয়ার কাজে গিয়ে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। জাতিসংঘে মানবাধিকারের যেসমস্ত সংস্থাগুলো রয়েছে, সেখানে তিনিই সর্বপ্রথম জুম্ম, সর্বপ্রথম আদিবাসী, সর্বপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে, যিনি এই অঞ্চলের মানুষের অধিকার, বঞ্চনা ও স্বপ্ন এগুলো নিয়ে কথা বলেছিলেন। তারপরে অনেকে তাঁর উদাহরণ অনুসরণ করে এদেশের মানুষের কথা, জাতিসংঘের কাছে বলেছেন।’

তিনি বলেন, ‘উনি যুক্তরাজ্যের একটি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি ধারণ করেও, কোনো চাকরি নেন নাই। উনি তাঁর শিক্ষা-উত্তর জীবনের সমগ্রটা কাটিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত মানুষের অধিকার নিয়ে এবং জাতিসংঘসহ পৃথিবীর বিভিন্ন সরকারের কাছে ও অন্যান্য অঙ্গনে কথা বলে গেছেন আমৃত্যু।’

রাজা দেবাশীষ রায় আরও বলেন, ‘তিনি খুব সাধারণভাবে একটি ছোট্ট ঘরে থাকতেন। এমনকি তাঁর কোনো টাইপ রাইটার ছিল না। তিনি হাতে লিখতেন, এরপর টাইপ রাইটারে লিখতেন। খুবই খুবই সাধারণ। সেজন্য উনি আমাদের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণার একজন ব্যক্তিত্ব। যাঁকে স্মরণ করে আমি আশা করবো যে, এই অঞ্চলের তথা দেশের মানুষ তাঁকে রোল মডেল হিসেবে, মেহনতি মানুষের অধিকারের জন্য কাজ করবেন।’

ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২২ এর আহ্বায়ক জুয়েল চাকমা বলেন, ‘ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রামে আত্মোউৎসর্গ করেছেন। তাঁর আত্মত্যাগকে বর্তমান জুম্ম ছাত্র যুব সমাজের কাছে তুলে ধরার জন্য এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে।’

উদ্বোধন শেষে পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী খিপ্প্যাপাড়া একাদশ ও রংখ্রে ডং একাদশের মধ্যকার খেলা অনুষ্ঠিত হয়। তুমুল উত্তেজনার মধ্য দিয়ে খেলাটি শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র হয়। ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হিসেবে নির্বাচিত হন জোড়া গোল করা রংখ্রে ডং একাদশ টিমের ৩০ নাম্বার জার্সি পরিহিত খেলোয়াড় উচহ্লা মারমা।

উল্লেখ্য, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র আন্তর্জাতিক মুখপাত্রজুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারকার্যের অন্যতম পুরোধা। তিনি ছিলেন একজন নিখাদ স্বজাতি ও স্বদেশপ্রেমিক, অত্যন্ত ত্যাগী ও সাহসী মানবাধিকার কর্মী এবং বিপ্লবী। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে তার হাত ধরে জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযানের পত্তন ঘটেছে যা ধীরে ধীরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘে জুম্মদের পদার্পণ এবং জুম্মদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার কাজটা তিনিই প্রথম শুরু এবং প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান ও সাদাসিধা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।

ছোটকাল থেকে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় খাগড়াছড়ির খবংপয্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৎসময়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হয়ে তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম শিক্ষাবিদ, সংগ্রামী ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব চিত্ত কিশোর চাকমার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত মহাপ্রুম এমই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে আবার সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ১৯৬১ সালে বিএসসি (অনার্স) ও ১৯৬২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কুইন এলিজাবেথ কলেজে ভর্তি হন এবং চার বছর পর এমফিল গবেষণা সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৮০ সালে রসায়নে সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষ করার পর ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিয়ে অচিরেই তিনি সম্পূর্ণভাবে জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রচার আন্দোলনে নিজেকে সমর্পণ করেন। জুম্ম জাতির সংগ্রামে নিজেকে সঁপে দেয়ায় ব্যক্তি জীবনে ড. দেওয়ান বিয়েও করেননি।

ড. আর এস দেওয়ানের জন্ম ৭ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবংপয্যা গ্রামে। তাঁর পিতা রমেশচন্দ্র দেওয়ান ও মাতা চন্দ্রমুখী দেওয়ান। পিতামাতার চার পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। তিনি মৃত্যুবরণ করেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ২৯ মার্চ যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টার শহরে নিজের এপার্টমেন্টে। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।