তবুও চিম্বুকে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ চলছেই, এলাকায় জনসাধারণের চলাচলে সেনা নিষেধাজ্ঞা

0
1146

হিল ভয়েস, ২ মে ২০২১, বান্দরবান: স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠীসহ দেশে-বিদেশে নানা জনের ও সংগঠনের ব্যাপক প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝর বয়ে গেলেও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ চলছে বলেই খবর পাওয়া গেছে। ম্রো জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদসহ স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের ক্ষতি করে এই নির্মাণ কাজ চলছে বলে তা বন্ধ করার জোরালো দাবি সত্ত্বেও তা ভ্রুক্ষেপ না করে নির্মাণকারীরা তাদের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

অতি সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সেখানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ভবন নির্মাণ, পানি সরবরাহ লাইন, অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের রাস্তা নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। আর ওই পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ভেতরে প্রবেশ এবং এর পাশ দিয়ে বা আশেপাশে ম্রোরাসহ সাধারণ মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

জানা গেছে, উক্ত এলাকায় এখন সবসময় সেনা সদস্য মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। কোনো জুম্ম সেদিকে চলাচল করলেই তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় এক ম্রো গ্রামবাসী জানান, আমরা সাধারণ মানুষ। আমাদের শক্তি নেই, ক্ষমতা নেই। আমরা কিছু করতেও পারছি না, শুধু দেখেও থাকতে পারছি না। আদিবাসী ম্রোদের জন্য ক্ষতিকর এই পর্যটন কেন্দ্র বন্ধে সকলকে এগিয়ে আসার দরকার।

উল্লেখ্য, চিম্বুক পাহাড় এলাকাটি আদিবাসী ম্রোসহ বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী আবাসভূমি, জুমভূমি ও বিচরণ ক্ষেত্র। যুগ যুগ ধরে তারা ওই এলাকায় বিচরণ, বসবাস ও জুম চাষ করে আসছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ ঐ এলাকায় বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ করছে জেনে শুরু থেকে ম্রো জনগোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এবং এই পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করার দাবি জানায়।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ চিম্বুক পাহাড় এলাকার ভূমিপুত্র আদিবাসী ম্রোরা চিম্বুক থেকে বান্দরবান সদর পর্যন্ত এক লং মার্চের আয়োজন করে। লং মার্চে চিম্বুক পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক আদিবাসী ম্রোদের ঐতিহ্যগত ভূমি বেদখল এবং এলাকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের দাবি জানানো হয়।

লং মার্চ শেষে বান্দরবান রাজার মাঠে আয়োজিত সমাবেশে ম্রোরা এক লিখিত বক্তব্যে বলেন, ম্রোদের ভূমি বেদখল করে চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে সিকদার গ্রুপ (আরএন্ডআর হোল্ডিংস) ও সেনাবাহিনী ‘ম্যারিয়ট হোটেল এন্ড রিসোর্টস’ নামে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে আমাদের আনুমানিক ১০০০ একর ভোগদখলীয় ও চাষের ভূমি বেদখল হওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলে আমাদের ৬টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদের মুখে পড়বে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, পবিত্র জায়গা, শশ্মান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া আমাদের সংরক্ষিত পাড়াবন ও জীববৈচিত্র্য অচিরেই ধ্বংস হবে।

ম্রোরা অচিরেই চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প বাতিল করার দাবি জানান।
সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, ‘জেলা পরিষদ প্লান্টেশন প্রজেক্টের নামে ভূমি নিয়ে কীভাবে পাঁচতারকা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের জন্য লিজ দিয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।’

জানা গেছে, সেনাবাহিনী বাগান করার প্রকল্পের নাম নিয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছ থেকে ২০ একর পরিমাণ ভূমি লিজ নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী সেখানে সিকদার গ্রুপের সাথে মিলে ফাইভ স্টার হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করছে। আরও জানা গেছে, হোটেলের প্রয়োজনে ২০ একর জমি নেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চতুর্পাশে সীমানা খুঁটি স্থাপনের কাজ করা হচ্ছে। এতে অন্তত ১০ হাজার ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও চাষাবাদের অধিকার সংকুচিত করবে।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় এক অধিকার কর্মী বলেন, পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী যেখানে বহিরাগত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট প্রদত্ত লিজ বাতিল করার কথা সেখানে সেসব লীজ বাতিল না করে উল্টো লীজ প্রদান করছে পার্বত্য জেলা পরিষদ। অপরদিকে বাগান করার নামে লীজ নিয়ে বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন সেটাও নৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।

এরপর গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ আদিবাসী ম্রোদের ভূমিতে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দেন দেশের ৫৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

গত ২ মার্চ ২০২১ সকালের দিকে ঢাকার শাহবাগে ম্রোদের দাবির পক্ষে এবং চিম্বুকে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের নামে ম্রো আবাসভূমি বেদখলের প্রতিবাদে সংহতি সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই সমাবেশেও ম্রোদের সাথে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বিভিন্ন নেতা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া সংহতি জানিয়ে সমাবেশে যোগদান করেন দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, উন্নয়ন সংস্থা, আদিবাসী সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

এর পাশাপাশি এ পর্যন্ত জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ সরকারের নিকট চিঠি প্রেরণ করেন। কিন্তু এরপরও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ তাদের কাজ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।