ঢাকায় পদযাত্রায় নেতৃবৃন্দ ‘ঔপনিবেশিক কায়দায় জুম্ম জনগণ শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত হচ্ছে’

0
1001

হিল ভয়েস, ৪ ডিসেম্বর ২০২০, ঢাকা: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে শাহবাগ অভিমুখে আজ সকালের দিকে পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। জাতীয় নাগরিক উদ্যোগ কর্তৃক আয়োজিত উক্ত পদযাত্রা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সংগঠনের শতাধিক নেতৃবৃন্দ উক্ত পদযাত্রা কর্মসূচিতে যোগদান করেন।

পদযাত্রাটি শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে প্রতিবাদী গান সহকারে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে শেষ হয় এবং সেখানে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ এর সঞ্চালনায় উক্ত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌরভ শিকদার। সমাবেশে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। এছাড়াও উক্ত সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর সভাপতি এবং বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মোস্তফা আলমগীর রতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রমুখ। এছাড়াও অডিও সংযোগে সংহতি বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ।

মূল বক্তব্যে অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের দিনটি নি:সন্দেহে পার্বত্যবাসীসহ পুরো দেশবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক ও শুভ দিন। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ও শুভ দিনটি পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতির সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কেননা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃংখলা, উন্নয়ন সহ সকল বিষয় স্থানীয় বিশেষ বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং ঔপনিবেশিক কায়দায় আজ জুম্ম জনগণ শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত হচ্ছে।’

ড. রোবায়েত ফেরদৌস অভিযোগ করে বলেন, ‘বর্তমানে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পথ কার্যত বেছে নেয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপন, জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অস্ত্রধারী, দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমুলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাশি, গ্রেফতার, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভত হত্যা, ষড়যন্ত্র মূলক মামলা দায়ের ইত্যাদি জোরদার করাসহ ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জণগণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অপপ্রচার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন।

তিনি অবিলম্বে কর্মপরিকল্পনাসহ পার্বত্য চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায়ন, পাহাড়ে সামরিকায়ন বন্ধ, ভূমি কমিশন কার্যকর, উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে জুমিয়া উচ্ছেদ বন্ধ, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবী জানান।

অডিও সংযোগে সংহতি বক্তব্যে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘যদি শান্তিচুক্তির ৩টি মৌলিক ধারাও বাস্তবায়িত হতো, তাহলে এই ২৩ বছরে বাকী সবগুলো ধারা বাস্তবায়িত হতো। কিন্তু প্রথম কয়েক বছরে চুক্তি বাস্তবায়নের যে অগ্রগতি ছিল তা এখন থমকে আছে। এই থমকে থাকার কারণ যদি রাষ্ট্র পক্ষ থেকে পরিষ্কারভাবে বলা না হয় তাহলে পাহাড়ের মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক।’

তিনি আরো বলেন, ‘পাহাড়ে যে হানাহানি ও রক্তপাত চলছে তা কারোর কাম্য নয়। যারা চুক্তি বাস্তবায়ন করবে এবং যারা এর সুফল পাবে সকলে মিলে এই চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হোক। এই চুক্তি বাস্তবায়নের সময় অনেক গড়িয়ে গেছে এবং আরো যদি কালক্ষেপণ করা হয় তবে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরী হবে। আর এই হতাশা পরবর্তীতে ক্ষোভে রূপ নেবে।’

সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর সভাপতি এবং বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য মোস্তফা আলমগীর রতন বলেন, ‘১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর যখন চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে তখন দেশ ও বিদেশের সবাই মনে করেছিল পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পরও আমাদেরকে আজ শাহবাগে দাঁড়িয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি করতে হচ্ছে যা খুবই দু:খজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে ভূমিকা রেখেছেন তারাই গত ১২ বছর ধরে শাসন ক্ষমতায় আছে।’ কিন্তু তারপরও এই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়াটা ক্ষোভের সৃষ্টি করে বলেও দাবি করেন ওয়াকার্স পার্টির এই নেতা।

সংহতি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে পাহাড়ের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সংস্থা হওয়ার কথা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। কিন্তু চুক্তির ২৩ বছর পর দেখা যাচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আঞ্চলিক পরিষদকে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায়নের দাবীও করেন এই আদিবাসী গবেষক।

সাম্প্রতিক চিম্বুকে পাঁচতারা হোটেল স্থাপন ইস্যুকে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন চুক্তির এত বছর পরও কার্যকর হয়নি। উপরন্তু পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় ভূমি বেদখল করা হচ্ছে। আঞ্চলিক পরিষদকে পাশ কাটিয়ে জেলা পরিষদ চিম্বুকে হোটেল স্থাপনের জন্য জমি লিস্ট দিচ্ছে যা হওয়ার কথা ছিল না। এই চুক্তি তাহলে কী কোনো খেলা ছিল?- বলেও প্রশ্ন রাখেন ঢাবির এই শিক্ষক।

এদিকে সংহতি বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী তীব্র ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যেভাবে বাঙালিরা বুকের রক্ত দিয়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলো ঠিক তেমনি পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেও বাঙালি পাহাড়ির রক্ত ছিল। এত বছর পরও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ’৭১ এর শহীদ এবং ১৯৯৭ পর্যন্ত পার্বত্য ইস্যুতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের সাথে বেঈমানী করা হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্যালেষ্টাইনে যেভাবে ইসরায়েলীদের পোড়ামাটির নীতির কারণে ফিলিস্তিনিদেরকে শেষ করে দেয়া হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের সাথে করা শান্তিচুক্তিও ভঙ্গ করা করা হয়েছে, ঠিক তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ক্ষেত্রেও তাই করা হচ্ছে।’ এক্ষেত্রে তিনি সবাইকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান।

তিনি আরো বলেন, এছাড়া মায়ানমারে রোহিঙ্গাদেরও মায়ানমারের অত্যাচারে একই অবস্থা হচ্ছে। আজ ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সাথে এদেশের সরকারের যে সমর্থন তার সাথে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না করার বিষয়টিকে তিনি দ্বিচারিতা বলে উল্লেখ করেন ঢাবির এই শিক্ষক।

সংহতি বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, কত আনন্দ ও সম্ভাবনা নিয়ে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মধ্যে কিছু অংশ নিশ্চয় বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয় নাই। যার জন্য পাহাড়ে এখনো কাঙ্খিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ‘পাহাড়ের আদিবাসী, অ-আদিবাসী, গরীব বাঙালি, কৃষক, মাঝি থেকে শুরু করে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামকে কেবল মাত্র চোখ দিয়ে নয়, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু কিছু লুঠেরা গোষ্ঠীর ব্যক্তিস্বার্থের কারণে আজ আমাদের জন্মভূমির নদী দূষিত, পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে, বন উজার হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে।’ উন্নয়নের নামে পাহাড়ে ভূমি বেদখল হচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন তিনি।

তিনি আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।

সমাপনী বক্তব্যে পদযাত্রা পরবর্তী সমাবেশের সভাপতি ড. সৌরভ শিকদার বলেন, ‘পাহাড়কে অশান্ত রেখে একুশ শতকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়।’ তিনি পার্বত্য চুক্তির শতভাগ বাস্তবায়ন করেই বাংলাদেশকে আরো সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।