ঢাকায় এমকে চাকমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠিত

0
491

হিল ভয়েস, ১১ মে ২০১৯, শনিবার, ঢাকাবাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে লেখক ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনকর্মী মঙ্গল কুমার চাকমার লেখা  ‘বিবর্ণ পাহাড়: পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান’ শিরোনামে গ্রন্থটির ‘মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা’ ১১ মে ২০১৯ ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ডব্লিউ.ভি.এ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান, বইটির প্রকাশক বটেশ্বর বর্ণন-এর পক্ষে বিলু কবীর প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক, নারীনেত্রী, সংগঠক ও যুব নেতৃবৃন্দ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন।

মঙ্গল কুমার চাকমা রচিত “বিবর্ণ পাহাড় : পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান” নামক বইটি ‘বটেশ্বর বর্ণন’ কর্তৃক গত বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে পার্বত্য এলাকারই এক ভূমিপূত্রের অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করা নিজস্ব আঙ্গিকে নতুন ধারার একটি বই এটি। এই বইয়ের মূল শিরোনাম “বিবর্ণ পাহাড়”। মূল শিরোনামের সাথে “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও সমাধান” উপ-শিরোনামের মধ্য দিয়ে বইটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু আন্দাজ করা যায়। বইটি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে লেখকের বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধগুলোর সংকলন। ‘লেখকের কিছু কথা’য় মঙ্গল কুমার চাকমা বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ঐতিহাসিক দিক, সমস্যার অন্তর্নিহিত বাস্তবতা, শাসকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ও তার ব্যাখ্যা, সম্ভাবনা ও সমাধানের উপায় নিয়ে লেখা প্রবন্ধগুলো এই গ্রন্থে স্থান দেয়া হয়েছে।” তবে বইটি প্রবন্ধ-সামগ্রী হলেও বিষয়বস্তু দিক থেকে একটি প্রবন্ধ থেকে আরেকটি প্রবন্ধ বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন নয়। বরঞ্চ লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা এক একটি প্রবন্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার এক একটি বিষয় এমনভাবে ক্রমান্বয়ে চয়ন করেছেন, যাতে একটি প্রবন্ধের সাথে আরেকটি প্রবন্ধের ধারাবাহিক সম্পর্ক নির্মিত হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সম্পর্কে একটি সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠেছে।

বইটিতে মুখবন্ধ লিখেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা। বইটি সম্পর্কে তাঁর মুখবন্ধে তিনি যথার্থভাবে বলেছেন, বইটিতে “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার ঐতিহাসিক দিক, সমস্যার অন্তর্নিহিত কার্যকারণ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা, সমস্যা সমাধানের উপায় সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা” হয়েছে। “পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও এ সমস্যা সমাধান সম্পর্কে সম্যকভাবে বুঝতে এই বইটি সহায়ক হবে” বলে শ্রী লারমা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

এই বইয়ে লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা বলতে চেয়েছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও স্বকীয় সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক স্বশাসনব্যবস্থা, স্মরণাতীত কাল থেকে বিরাজমান জুম্ম অধ্যুষিত এলাকার মর্যাদা ও বিধিব্যবস্থার প্রতি দেশের শাসকশ্রেণির অব্যাহত অস্বীকৃতির ফলে স্মরণাতীত কাল থেকে শান্তিপূর্ণ ও জাতিগত সম্প্রীতিতে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম অশান্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই ঐতিহাসিক সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আপামর পার্বত্যবাসী অঢেল আশায় বুক বেঁধেছিল এ সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে। কিন্তু যে ঐতিহাসিক চুক্তিতে দেশের শাসকশ্রেণি আবদ্ধ হয়েছিল, জুম্ম জনগণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসন প্রদানের যে অঙ্গীকার করেছিল, জুম্ম অধ্যুষিত জুম পাহাড়ের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের যে প্রতিশ্রতি দিয়েছিল, আজ সেই চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি প্রতি পদে পদে ভূলণ্ঠিত হয়ে চলেছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ অবাস্তবায়িত রেখে পূর্বসূরিদের মতো তারা জুম্ম স্বার্থ বিরোধী ও চুক্তি পরিপন্থী নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার যথাযথ সমাধানের কোন বিকল্প নেই বলে লেখক শ্রী চাকমা উল্লেখ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিহিত রয়েছে বলে তিনি বস্তুনিষ্ঠ ও যথাযথ মতামত তুলে ধরেছেন। পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের যে অঙ্গীকার করা হয়েছে, জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীদের যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে, তার যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য সমস্যার টেকসই সমাধান নিহিত রয়েছে বলে তিনি বইটিতে উল্লেখ করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম একজন ভুক্তভোগী জুম্ম সদস্য হিসেবে তাঁর মনের গভীর থেকে যেভাবে সমস্যার অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো অনুভব করেছেন, একজন মানুষ হিসেবে সহজাত অধিকারের কামনা করেছেন, ভুক্তভোগী হিসেবে তিনি যে অব্যক্ত যাতনায় বিদ্ধ হয়েছেন, সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা অবলোকন করেছেন ও অফুরন্ত আশায় বুক বেঁধেছেন তারই আলোকে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন বলে তিনি তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা আরো উল্লেখ করেছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে। রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতের ফলে একদিকে জুম্ম জনগণের আত্মত্যাগ করতে হয়েছে অনেক তাজা প্রাণের, তেমনি প্রাণ দিতে হয়েছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর অনেক জওয়ানেরও। ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার অর্থ ও সম্পদের। পাহাড়ি-বাঙালি অনেক সাধারণ মানুষের সইতে হয়েছে অবর্ণনীয় দু:খকষ্টের। ১৯৭২ সালে তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দাবি ও প্রস্তাব অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করা হলে এ ধরনের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও অসহনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখী হতে হতো না। আড়াই দশক ধরে হানাহানি ও সংঘাতের পর ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সত্তর দশকের ভুল সংশোধনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একটা স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্র। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২২ বছরেও পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে এখন সকলের সামনে জরুরী প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আমরা দেশবাসী, সরকার, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা-গোয়েন্দা-নিরাপত্তা বাহিনী, জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নীতি-নির্ধারক, নাগরিক সমাজ, জুম্ম জনগণ কি পার্বত্য চুক্তির পথে হাঁটবো নাকি ১৯৭২ সালের মতো আবার ভুল পথে পা বাড়াবো?

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল নাগরিক সমাজসহ পার্বত্যবাসী যারপরনাই ক্ষুব্ধ, অসন্তোষ্ট ও হতাশাগ্রস্ত। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অনেকটা চুক্তি-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। বিরাজমান এই পরিস্থিতিকে বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন ও অভিমত প্রদান করে চলেছে। প্রভাবশালী একটি কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল পার্বত্য চট্টগ্রামের এই পরিস্থিতিকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতা, বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ ইত্যাদি অপরাধে অভিযোগ তুলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে জড়িত ও সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার জুম্ম জনগণকে দেশে-বিদেশে ‘ক্রিমিনালাইজড’ করা হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতেই এবং নাগরিক সমাজ ও জুম্ম জনগণের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম হিসেবে অবতারণা করতেই এই স্বার্থান্বেষী মহল এ ধরনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিবেচনা করা যায়। এতে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলছে এবং পূর্বের মতো জুম্ম জনগণকে আবারো দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে জিইয়ে না রেখে যারা সমস্যার একটা প্রকৃত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান চান, দলন-পীড়নের পরিবর্তে যারা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাধান কামনা করেন, তারা বরাবরই অভিমত প্রকাশ করে চলেছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের একমাত্র উপায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। তাই এই বইয়ের শেষ প্যারাগ্রাফে লেখক মঙ্গল কুমার চাকমা যেভাবে বলেছেন সেভাবে বলতে হয় যে, দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থেই এ চুক্তি যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। তাই আর বিলম্ব না করে দেশের সামগ্রিক স্বার্থে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পূর্বক সরকারকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।