হিল ভয়েস, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বিশেষ প্রতিবেদক: রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১৩-তে অবস্থিত শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশ করে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ (প্রসিত) সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের একদল ক্যাডার অভি চাকমা নামে এক ছাত্রকে মারধর করেছে বলে জানা গেছে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ও প্রসিতপন্থী ইউপিডিএফের ক্যাডার ট্যালেন্ট চাকমার নেতৃত্বে একদল উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র-যুবক এই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে।
অভি চাকমা (২৩) চুক্তির পক্ষের ছাত্র সংগঠন পিসিপির মিরপুর থানা শাখার সভাপতি বলে জানা গেছে।
সরেজমিন তদন্তে জানা গেছে, ঐদিন ঢাকার মিরপুর-১৩ তে অবস্থিত শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারে মধু পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যার দিকেও পূণ্যার্থীরা গৌতম বুদ্ধের মূর্তির সম্মুখে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করতে আসে। রাত আট ঘটিকার পর জনসমাগম বেশ খানিকটা কমে আসে। ঐ সময়ে অভি চাকমা ও তার কয়েকজন বন্ধু মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের পর বিহার প্রাঙ্গণে আম গাছের নিচে বসে তাদের নিত্য দিনকার বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছিল।
এমন সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্টের ছাত্র এবং ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার ট্যালেন্ট চাকমার নেতৃত্বে একদল উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র-যুবক কিছু স্থানীয় বাঙালি যুবককে নিয়ে বিহার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে “অভি চাকমা কোথায়, অভি চাকমা কোথায়?” বলে চেঁচাতে থাকে। অভি চাকমা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি অভি। কিছু হয়েছে নাকি?” ট্যালেন্ট চাকমা উত্তর দেয় “তোমার সাথে কিছু কথা আছে। বাইরে চল আমাদের সাথে।“ ঐ সময় ট্যালেন্ট চাকমার গ্রুপের সাদা শার্ট পরিহিত লম্বা চুল এবং কাঁধে কালো ব্যাগ বহন করা এক যুবক অভি চাকমাকে বুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সেই সাথে অন্য পাশ থেকে নীল জার্সি পরিহিত আরেক লম্বা চুল রাখা যুবক ও রিপরিপ চাকমা চেঁচিয়ে ওঠে “মার, মার ওকে।“
ঘটনার এই অবস্থায় অভি চাকমার বন্ধুরা তাকে রক্ষার্থে ঢাল হিসেবে সামনে চলে আসে এবং আত্মরক্ষার্থে ট্যালেন্ট চাকমার গ্রুপকে সরানোর চেষ্টা করতে থাকে। এক পর্যায়ে জানা যায়, সাদা শার্ট পরিহিত লম্বা চুলের যুবক তার ব্যাগ থেকে কালো রঙের একটি ফোল্ডেবল স্টিক বের করে এবং সেটি দিয়ে অভি চাকমা ও তার বন্ধুদেরকে আঘাত করতে থাকে। তাদের চিৎকার ও মারামারির আওয়াজ শুনে বিহারে কর্তব্যরত এবং আগত পুরুষ পূণ্যার্থীগণ দ্রুত দৌঁড়ে এসে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু ট্যালেন্ট চাকমা ও সঙ্গীরা বিহার প্রাঙ্গণে রাখা কিছু প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে অভি চাকমা ও তার বন্ধুদের উপর আঘাত করতে শুরু করে। এতে অন্তত সাত থেকে আটটি চেয়ার ভেঙে যায়।
এক পর্যায়ে বিহার কর্তৃপক্ষের একজন লোক তখন সাদা শার্ট পরিহিত লম্বা চুল যুবকের কাছ থেকে ফোল্ডেবল স্টিকটি কেড়ে নেয় এবং এক পর্যায়ে বিহার গেইটে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মীগণকে বলা হয় গেইট বন্ধ করে দিতে। তৎক্ষণাৎ অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে রিপরিপ চাকমা, নীল জার্সি পরিহিত লম্বা চুলের যুবক ম্যাকসিল চাকমা এবং অন্তত আট থেকে দশজন যুবক দ্রুত সরে পড়ে এবং গেইটের বাইরে চলে যায়।
নিরাপত্তা প্রহরী তখন দ্রুত গেইটে তালা দেয়। তখন রিপরিপ চাকমা এবং অন্যান্যরা গেইটের বাইরে থেকে চেঁচাতে থাকে। এতে ভেতরে আটকা পড়ে ট্যালেন্ট চাকমা এবং তার এক বন্ধু। পরবর্তীতে তাদেরকে আর কোনোদিন বিহার প্রাঙ্গণে এসে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার জন্য সতর্কতা দেওয়া হয় এবং কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদেরকে বিহার প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেওয়া হয়।
ঘটনার পর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাত ৮টা ২৩ মিনিটের দিকে প্রথমে ট্যালেন্ট চাকমা, সাদা শার্ট পরিহিত লম্বা চুলের যুবকসহ ৪ জন বিহার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং এরপর রিপরিপ চাকমা ও নীল জার্সি পরিহিত লম্বা চুলের এক যুবক প্রবেশ করে। এর পরবর্তী মিনিটে তাদের গ্রুপের অন্যান্যরা আট থেকে নয়জন বাঙালি যুবককে সাথে নিয়ে বিহার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। বিভিন্ন সূত্র এবং সাক্ষ্য মারফত জানা যায়, উইন চাকমা উক্ত স্থানীয় বাঙালিদের ফোন করে ডেকে আনে।
ঘটনার পরবর্তী দিন সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে ফুটেজ বিশ্লেষণ করে যেসকল যুবকের চেহারা শনাক্ত করা গিয়েছে এবং বিভিন্ন মাধ্যমের সূত্র ধরে পরিচয় জানা গিয়েছে তা নিম্নরূপঃ
১। ট্যালেন্ট চাকমা, ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের ঢাকা মহানগরের কর্মী। ট্যালেন্ট চাকমা খাগড়াছড়ির মাইসছড়ি হাই স্কুলের শিক্ষক সুবল স্মৃতি চাকমার ছেলে এবং ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপের কমান্ডার রতন স্মৃতি চাকমার ভাতিজা।
২। সাদা শার্ট পরিহিত লম্বা চুলের যুবকের নাম জানা গিয়েছে দিপাশ চাকমা। দিপাশ চাকমার বাড়ি খাগড়াছড়ি সদরস্থ নারাঙহিয়া এলাকায়। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার একজন কর্মী।
৩। নীল জার্সি পরিহিত লম্বা চুলের যুবকের নাম জানা গিয়েছে ম্যাকসিল চাকমা। তার বাড়ি বাঘাইছড়ির বঙ্গলতলি এলাকায়। ম্যাকসিল চাকমা ইউপিডিএফ সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য শিব রঞ্জন চাকমার ছেলে। বঙ্গলতলি এলাকার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে তারা সাজেক মাচালং এলাকায় থাকে বলে স্থানীয় সূত্র মারফত জানা গিয়েছে।
৪। হাফ স্লিভ সাদা শার্ট পরিহিত যুবকের নাম রিপরিপ চাকমা। রিপরিপ চাকমা ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের ঢাকা মহানগর শাখার একজন কর্মী।
উক্ত হামলার ঘটনার পর বিভিন্ন পূণ্যার্থীগণ বিহার প্রাঙ্গনে এসে হামলার সমালোচনা করেন। তারা বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসে এধরনের হামলা বিহারের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিকে কলুষিত করে। এতে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং বিহারের নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
উল্লেখ্য, গত ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও কেন্দ্রীয় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগর শাখার পিসিপি কর্মীরা মিরপুরে পোস্টারিং করতে গেলে পরপর দুইবার ইউপিডিএফ(প্রসিত) গ্রুপের ছাত্র সংগঠনের ক্যাডার ট্যালেন্ট চাকমার নেতৃত্বে পোস্টার ছিঁড়ে দেওয়া হয়। তৃতীয়বার কর্মীরা পোস্টারিং করতে গেলে ট্যালেন্ট চাকমার নেতৃত্বে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীর সহায়তায় পিসিপির কর্মীদের উপর হামলা করা হয়। হামলার প্রেক্ষিতে কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়।