হিল ভয়েস, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ঢাকা: আজ রবিবার (৭ ডিসেম্বর) মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন-এর উদ্যোগে বাংলাদেশের আদিবাসীদের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কাপেং ফাউন্ডেশনের এ্যাডভোকেসী অফিসার হ্লাম্রাচিং চৌধুরী রনি’র সঞ্চালনায় কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনটির চেয়ারপার্সন গোরাঙ্গ পাত্র।
কর্মশালায় ফ্রান্স দূতাবাসের পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স কো-অপারেশন বিভাগের মিস এমিলি বলেন, শুধুমাত্র বাংলাদেশে না, বিশ্বব্যাপী আদিবাসীরা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছেন। তারা তাদের ভূমি, সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রক্ষা করতে গিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। একই সাথে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রান্তিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষভাবে সমস্যার শিকার হচ্ছেন আদিবাসী নারীরা। তিনি বলেন, এ সকল সমস্যাগুলো নিরসনের জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জবাবদিহিতা অত্যন্ত জরুরী। তিনি আদিবাসীদের মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য ফ্রান্স দূতাবাসের সহযোগিতা সর্বদা চলমান থাকবে বলেও অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট পার্থ শঙ্কর সাহা বলেন, সারা বাংলাদেশে এখন হত্যা ও ধর্ষণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সরকারের উপদেষ্টারা মুখে শুধু সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেন না। শুধুমাত্র আইন করা হচ্ছে কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। তিনি বলেন, আদিবাসীদের উপর সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর ডকুমেন্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রকাশনাসহ ডকুমেন্টেশনের প্রচার ও প্রসার বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এ্যাডভোকেসী বিভাগের পরিচালক জনা গোস্বামী বলেন, সমতলের আদিবাসীরা এখনো সুসংগঠিত না। প্রতিনিয়তই তারা নিপীড়ন নির্যাতনের মুখোমুখি হয়ে বাস্তুভিটা হারাচ্ছেন। এ বিষয়ে প্রশাসন নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, মানবাধিকারের বোধ কোন সরকারের মধ্যে নেই। শুধুমাত্র আদিবাসী শব্দটি নিয়েই বিভিন্ন ঝামেলা হচ্ছে। মব জাস্টিসের ভয়ে অনেকেই কোন কিছু বলছেন না। ডিজিটাল সিকিউরিটি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়েও কেউ কোন কিছু বলার সাহস করছেন না।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া দেশ চলতে পারে না। এ লক্ষ্যে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে হবে। তিনি আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষা ও আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ প্লাটফর্মে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ আসন সংরক্ষণ ও আলাদা নির্বাচনের দাবি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সরকারের জনশুমারীতে আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়েছে। জনশুমারির সময়ে অনেক প্রান্তিক আদিবাসীদের এলাকা বাদ পড়ে গিয়েছে। আদিবাসীদের জন্য আলাদা করে জনশুমারী করা হোক। তিনি আরও বলেন, বিচারব্যবস্থার কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বিচারব্যবস্থা স্বাধীন হওয়া মানেই আদিবাসীদের উপর সংগঠিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার হবে তা ভাবা ভুল হবে। বিচার বিভাগ আদিবাসী বান্ধব, নারী বান্ধব, দুর্বল, ক্ষমতাহীন মানুষ তথা জনবান্ধব হতে হবে।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আশা ছিলো যে জুলাই অভ্যুত্থানের পরে দেশের আদিবাসী মানুষেরা আরো বেশী অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু আমরা সেদিকে যেতে পারিনি। সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশের স্বপ্ন বিনির্মাণ করা যায়নি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ৬৯ টি দেশে শান্তি মিশন পরিচালনা করেছে। বর্তমানে ১০ টি দেশে পরিচালনা করছে। যে বাহিনী সারাবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার কাজ করছে সে বাহিনী কেন দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে না? মূলত সেনাকর্তৃত্বের কারণেই দেশের আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার যদি সেনাকর্তৃত্ব সমাধান না করতে পারে তাহলে জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করুক। কোন জনগোষ্ঠীকে যুগ যুগ ধরে নির্যাতন চালিয়ে, শাসন করে দমিয়ে রাখা যায় না। পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসী মানুষের অধিকারের আন্দোলন দেশের সমগ্র মানুষের আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন গোরাঙ্গ পাত্র বলেন, ২৪-এর যে বহুত্ববাদের স্বপ্ন সেটি এখন মৌলবাদীদের হাতে চলে যাচ্ছে। খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মত ঘটনাগুলো এখন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। পাহাড়ে সেনাবাহিনী যা ইচ্ছা তাই করছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা নাই সেখানে হস্তক্ষেপ করার। তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশায় আঘাত, নারীদের শ্লীলতাহানি এবং সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মন থেকে আদিবাসীদের অধিকারগুলোকে মেনে নিতে না পারলে, তাদের পরিচয়কে মেনে নিতে না পারলে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত হবে না।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, রাষ্ট্র দেশের আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সমস্ত চুক্তি ও ঘোষণাপত্রে অনুস্বাক্ষর বা অনুসমর্থন দিয়েছে সেই অঙ্গিকারগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগ্রতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনটির প্রজেক্ট অফিসার ত্রিজিনাদ চাকমা। মূল বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী জাতিসমূহ এখনও অস্তিত্ব হুমকীর মধ্যে দিন যাপন করছেন। মানবাধিকার লংঘনের শিকার হতে হতে তারা আজ অসহায় ও দিশেহারা। কাপেং ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালে, বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর মোট ৯৭ টি মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ভূমিকেন্দ্রিক ঘটনা ঘটেছে ১৮টি, যার মধ্যে সমতলে ৪টি ও পাহাড়ে ১৪টি এবং মোট ১০০৭ জন এসব ঘটনার শিকার হয়েছেন। পাশাপাশি, মোট ৬১টি ঘটনায় ৩৪১ জন ব্যক্তি রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন যেখানে ৩টি ও ৫৮টি ঘটনা যথাক্রমে সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হয়েছে। অপরদিকে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই ২০২৫ রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫টি ভূমিকেন্দ্রিক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটেছে। ৩৪টি রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যেখানে মোট ৩৬৮ জন আদিবাসী মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছেন। এ সকল ঘটনাগুলোর একটিরও যথাযথ তদন্তপূর্বক সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি।
বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষা ও সমুন্নত করতে ত্রিজিনাদ চাকমা নিম্নোক্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
১. পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি আনয়নের জন্য অবিলম্বে রোডম্যাপ প্রণয়নপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা।
২. আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
৩. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।
৪. বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ করা ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে এযাবতকালে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৫. আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সরকারি ও বেসরকারি কর্মসূচী ও নীতিমালা প্রণয়ন করা।
কর্মশালায় মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের ইউজিন নকরেক, কুবরাজ ইন্টার-পুঞ্জি ডেভেলপম্যান্ট এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং, সিএইচটি জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ এসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক সন্তশিতো চাকমা বকুল, নমিতা চাকমা প্রমুখ।