“ছাত্র সমাজকে একাডেমিক শিক্ষালাভের পাশাপাশি নিজের শেকড়কে নিয়ে ভাবতে হবে”– চবিতে ঊষাতন তালুকদার

0
802

হিল ভয়েস, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, চট্টগ্রাম: গতকাল ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ রোজ শুক্রবার “বুনোফুল সৌরভ ছড়াবে নবীনের আগমনে, অস্তিত্ব রক্ষায় হাত মেলাবো আত্মার টানে” ¯স্লোগানে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের নবীন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের বরণ ও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের আদিবাসী শিক্ষাথীদের বিদায় সংবর্ধনা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অডিটোরিয়াম হলে অনুষ্ঠিত হয়।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে সকালের পর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়া আদিবাসী নবীন শিক্ষার্থীদের পরিচয় ও অনুভূতি প্রকাশ এবং ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পরিচিতি ও স্মৃতিচারণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সকালের পর্বে সঞ্চালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুইসাইন মারমা ও সুইটি দেওয়ান।

বিকালের আলোচনা সভা পর্বে উপস্থিত ছিলেন ২৯৯ নং পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও নবীন বরণ ও বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ঊষাতন তালুকদার এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপ-উপাচার্য প্রফেসর বেনু কুমার দে, পালি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা, সহকারী প্রক্টর ও পালি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অরূপ বড়ুয়া, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক জেসী ডেইজী মারাক এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি ছাত্রনেতা সুমন মারমা প্রমুখ। সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণ চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক রুমেন চাকমা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য বিনিময় চাকমা।

অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বরণমাল্য পাঠ করেন পালি বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ামনি চাকমা এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইলি চাকমা। নবীন শিক্ষার্থীদের মানপত্র ও ফুল দিয়ে বরণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর বেনু কুমার দে এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মানপত্র, ফুল ও উপহার সামগ্রী দিয়ে সংবর্ধিত করেন ঊষাতন তালুকদার।

নবীন শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ডচেংনু চৌধুরী এবং বিদায়ী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শ্রীবর্ণী চাকমা।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ঊষাতন তালুকদার বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড় এখনো অস্থিতিশীল রয়েছে। পাহাড়ে এখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। পুঁজিপতি ও মুনাফাখোররা প্রশাসনের সহায়তায় আদিবাসীদের ভূমি বেদখল করছে। পার্বত্য অঞ্চল এখনো দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের শেকড় পাহাড় যদি সংকটময় থাকে তবে আমরা যেখানেই যায়না কেন কোথাও সুখে থাকতে পারব না। ছাত্র সমাজকে একাডেমিক শিক্ষালাভের পাশাপাশি নিজের শেকড়কে নিয়ে ভাবতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পুলিশ কনস্টেবল মহুয়া হাজং তাঁর বাবার সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মামলা করতে চাইলেও প্রশাসনের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছেন না। সাধারণ জনগণ অর্থবিত্ত ও ক্ষমতাবানদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। সংবিধানের সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও সাধারণ জনগণ এখনো বঞ্চিত। অধিকার পেতে হলে শিক্ষিত বিবেকবান মানুষকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।”

আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি প্রফেসর বেনু কুমার দে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। মানুষ জন্মলগ্নে মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মায় না, তাঁকে মনুষ্যত্ব অর্জন করে নিতে হয়। প্রবীণেরা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে একটি সুন্দর জীবন গঠনে নেমে পড়বেন। উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে নিজের সমাজ ও জনগোষ্ঠীকে অনগ্রসরতা থেকে অগ্রসর করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আদিবাসী কোটায় আসন বৃদ্ধি করার আশ্বাস প্রদান করেন।”

বিশেষ অতিথি প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষু বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া বড় কথা নয়, মানুষের মতো মানবীয় গুণাবলি অর্জন করে ভালো মানুষ হওয়াটাই হলো বড় কথা। দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। আপনারা সবাই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হলে আপনাদের মধ্যে ন্যায়, নম্রতা, ভদ্রতা চলে আসবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো প্রাইমারি-হাইস্কুল গড়ে উঠেনি। ফলে সে অঞ্চলে জনগোষ্ঠীরা এখনো শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে রয়েছে। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়ায় বলে সেখানকার বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারি।”

বিশেষ অতিথি সুমন মারমা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্বমানের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে ঘুরলে দেখা যায় পার্বত্য অঞ্চল এখনো অনেক পশ্চাৎপদ। অধিকার বঞ্চনা করে পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নিয়ে পাহাড়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। পাহাড়ের যেকোনো জায়গায় গেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেকপোস্টে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। একজন শিক্ষার্থীকে তাঁর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ভাবা নৈতিক দায়িত্ব। নিজের সমাজ, জাতি ও মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্ববোধ থাকতে হবে। আমাদেরকে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।”

এছাড়াও আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাঞ্চন চাকমা, সহকারী প্রক্টর ও পালি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব অরুপ বড়ুয়া, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক  জেসি ডেইজি মারাক প্রমুখ।

আলোচনা সভা শেষে রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পীবৃন্দের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নবীন বরণ ও বিদায় সংবর্ধনা ২০২১ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।