চিম্বুকে ম্রো আবাসভূমিতে হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ঢাকায় সংহতি সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি

0
900
ছবি: সংহতি সমাবেশের একাংশ

হিল ভয়েস, ২ মার্চ ২০২১, ঢাকা: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের নামে ম্রো আবাসভূমি বেদখলের প্রতিবাদে ঢাকার শাহবাগে সংহতি সমাবেশ ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে।

আজ ২ মার্চ ২৯২১ সকালের দিকে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে ‘চিম্বুক পাহাড় ম্রো ভূমি রক্ষা আন্দোলন’ কর্তৃক আয়োজিত উক্ত সংহতি সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড় থেকে ঢাকায় সমাবেশ করতে আসা ম্রো আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী প্লুং বাশির সুর দিয়ে শুরু হয় এই সংহতি সমাবেশ।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঞ্চালনায় উক্ত সমাবেশে সংহতি বক্তব্য রাখেন আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা, বিশিষ্ট নাট্যকার মামুনুর রশীদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হোসেন, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঢাবি শিক্ষক ড. জোবায়দা নাসরীণ কণা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, চিম্বুকের ম্রো আদিবাসীদের পক্ষে ছাত্রনেতা রেং ইয়ং ম্রো প্রমুখ।

ম্রোদের দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আমাদের এখন প্রশ্ন, রাষ্ট্রের মালিক কে? সিকদার গ্রুপের মত লুটেরা গ্রুপ কী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মালিক বনে গেছে কিনা সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, এটা কেবল ম্রো আদিবাসীদের বিষয় নয়। চিম্বুক পাহাড় বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। কাজেই এই ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। স্বাধীনতার মাসে বলতে হচ্ছে, আমরা এজন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি এবং এই লুটেরাদের হাতে বাংলাদেশকে ছেড়ে দিতে পারি না। পাহাড়, বন ও আদিবাসীদের ধ্বংস করে কোনো লুটেরা গ্রুপ ও কর্পোরেট গ্রুপকে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না বলেও হুশিয়ারি দেন এই সাংসদ।

সমাবেশে সংহতি বক্তব্যে নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, আমার বিশ্বাস যতই তারা পায়তারা করুক পাঁচতারা হোটেল সেখানে হতে পারবে না। সারা বিশ্বের পরিবেশবাদী মানুষ জেগে উঠবে। ম্রো’দের প্লুং বাঁশির হাহাকার শাসকদের শুনতে হবে। চিম্বুকের ম্রো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে সেখানে কেন উন্নয়ন করতে হবে বলেও প্রশ্ন করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, হোটেল করে কেন সমস্ত জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করতে হবে। অবিলম্বে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বানও জানান এই বিশিষ্ট নাট্যকার।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, আমরা এখানে সমবেত হয়েছি কারণ এই ম্রোদের বাঁশির আওয়াজ কারো কানে পৌঁছাচ্ছিল না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কেবল বান্দরবানের ম্রো নয়, পাহাড়ের ও সমতলের সকল আদিবাসীরা আজ শঙ্কিত যে, এভাবে উন্নয়নের নামে ধীরে ধীরে আমাদেরকে নি:শেষ করে দেয়া হবে কিনা।

তিনি আরো বলেন, আমাদের অস্তিত্ব যেখানে বিপন্ন, মানবাধিকার যেখানে বিপন্ন, সেখানে আমাদের বাড়ির পাশে উন্নয়নের নামে পাঁচতারা হোটেল হবে তা তো মেনে নেয়া যায় না। এটা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।

সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ম্রো ভূমিতে কারা হোটেল বানাচ্ছে তাদের ‘ক্যারেক্টার’ চিনে নেওয়া উচিত। এই হোটেল যারা বানাচ্ছে তাদের অন্যতম সিকদার গ্রুপ। ম্রো আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে সেখানে পাঁচতারা হোটেল করবেন আর বিত্তশালী মানুষ সেখানে আমোদ করবে, বিহার করবেন তা হতে পারে না। পাহাড়ের আদিবাসীরা অশিক্ষিত হয়ে পড়ে থাকবে আর তাদেরকে পর্যটকদের দেখানো হবে পর্যটনের অংশ হিসেবে, তা হতে পারে না। হোটেলের পরিবর্তে পাহাড়ে স্কুল ও কলেজ স্থাপনেরও দাবি করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালিদেরকে চব্বিশ বছর শোষণ করেছে। আর স্বাধীনতার পর বাঙালিরাই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদেরকে শোষণ করছে। পাহাড়ের মানুষরা জাতি বৈষম্য ও ভাষা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পাহাড়ে জায়গার নাম বদলে দিয়ে ইসলামিকরণ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ঢাবি’র এই শিক্ষক। আর তার জন্য ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।

পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন ‘বেলা’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আদিবাসীদের নিজেদের জীবনের ব্যাপারে কিছু পছন্দ আছে। এই ম্রোরা কিছুতেই তারা এই পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের জন্য সম্মতি দেননি। কাজেই এই জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। সেনাবাহিনীর সাথে সিকদার গ্রুপ এবং এই প্রকল্পের সাথে জড়িত সকল চুক্তি বাতিল করে ম্রো জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।

কমিউনিস্ট পার্টির নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অনেকের কাছে মনে হতে পারে এটা একটা সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু আমার কাছে এটা বিভৎস দৃশ্য। এই বিভৎস দৃশ্যের সাথে কারা জড়িত তা আমরা জানি। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং সাথে সিকদার গ্রুপ। পাহাড়ের এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সরকারের বোধোদয় হতে হবে।

সংহতি বক্তব্যে ড. জোবায়দা নাসরীণ গত কিছুদিন আগে চিম্বুকের সেই স্পট দেখে আসার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, এমনভাবে সেই প্ল্যানটি করা হচ্ছে কেবল মাত্র ২০ একর জমি নিয়ে নয়। সেখানে যেটা করা হচ্ছে তা পুরো চিম্বুককে দখল করার জন্য।

তিনি আরো বলেন, চিম্বুকের সেই পর্যটন স্পটে যে বিলবোর্ড টানানো হয়েছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ছবিও আছে। কাজেই সেই ছবির উপস্থিতি আমাদেরকে ভয় ধরিয়ে দেয় যে, এই বিধ্বংসী প্রকল্পের সাথে কী প্রধানমন্ত্রীও জড়িত! কাজেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এই প্রকল্পটি না চান এবং এর সাথে কোনো সম্পৃক্ততা না থাকে তাহলে অবশ্যই নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে সেটা স্পষ্ট করতে হবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ম্রো জনগোষ্ঠীর মূল দাবি হল, তারা যেখানে শত বছর ধরে বসবাস করছে সেখানে তারা নিজেদের নীরবে জীবনযাপন করবে। এটা খুব একটা বড় দাবি নয়। কাজেই তাদের জীবন, জীবিকা, শিল্প, সংস্কৃতি ধ্বংস করে সেখানে হোটেল করার পরিকল্পনা কোনো সুষ্ঠু মানুষ মেনে নিতে পারে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আমাদেরকে নিজেদের মত করে বাঁচতে না দেওয়ার জন্য। কাজেই এই হোটেল নির্মাণও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও পার্বত্য চুক্তির পরিপন্থি।

বান্দরবানের চিম্বুক থেকে আসা ম্রো আদিবাসী মেনচিন ম্রো স্বীয় ভাষায় সংহতি বক্তব্য রাখেন এবং বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন জাহঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতা রেং ইয়ং ম্রো। মেনচিন ম্রো তাঁর বক্তব্যে বলেন, নীলগিরি আমাদের জুম ভূমি ছিল। সেই নীলগিরি পর্যটন হওয়ার সময়ে আমাদের আত্মকর্মস্থানের সুযোগ হবে, দোকানপাট করে দেয়া হবে বলে নানাভাবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এইসব করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের যে পানির উৎস সেখানে বাঁধ দিয়ে নীলগিরি কর্তৃপক্ষ পানি সংগ্রহ করছে। যার ফলে বছরে ছ’মাস আমাদেরকে পানি কষ্টে ভুগতে হয়।

তিনি আরো বলেন, এই ঢাকা শহরে কোনো দিন আসি নাই। এমনকি আসতে হবে তাও ভাবি নাই। কিন্তু আমাদের পাহাড়ে যদি আমাদেরকে নিজেদের মত করে বাঁচতে দেয়া না হয় তাহলে আমাদেরকে যদি মারাও যেতে হয় আমরা শত বছর এর প্রতিবাদ করে যাবো।

চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো আদিবাসীদের পক্ষে সংহতি জানিয়ে ছাত্রনেতা রেং ইয়ং ম্রো বলেন, আমরা যতভাবে সম্ভব এবং যেভাবে আমাদের আবেদন-নিবেদন জানানো উচিত সেটার সবগুলোই আমরা করেছি। আমরা দেখেছি চিম্বুকের এই প্রকল্প হলে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হবে। তাই আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু কোনো ধরনের প্রতিকারের ব্যবস্থা না করে যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে উল্টো তাদেরকে হয়রানি করা হচ্ছে। আগামী ২৬ মার্চের মধ্যে যদি এই প্রকল্প বাতিল করা না হয় তাহলে নাইতং পাহাড়কে ঘিরে পাহাড়ে যে ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটার দায় সরকারকে নিতে হবে।

সমাবেশের সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ানের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উক্ত সমাবেশ শেষ হয়। সমাবেশ শেষে একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে শাহবাগ ফিরে আসে। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভিমুখে স্মারকলিপি প্রদানের জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করতে যায়।

এছাড়া সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রেহনুমা আহমেদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার আন্দোলনের নেতা জুয়ামলিয়ান আমলাই বম, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন।

এছাড়া সমাবেশের সাথে সংহতি জানায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি, ব্লাস্ট, কাপেং ফাউন্ডেশন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, বেলা, সিপিবি, বাসদ, জাসদ, জনউদ্যোগ, বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি, ঐক্য ন্যাপ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, বাপা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম সামাজিক ছাত্র সংগঠন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, গানের দল মাদল, আদিবাসী যুব ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।

উক্ত সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট নিম্নোক্ত দাবিসমূহ পেশ করা হয়-
১. ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, প্রাকৃতিক সম্পদে প্রথাগত অভিগম্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ম্রো অধ্যুষিত এলাকায় ম্যারিয়ট হোটেল ও বিনোদন পার্ক নামক প্রকল্পটি অবিলম্বে বাতিল করা;
২. ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালের সম্পাদিত ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের সাথে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের ইজারা চুক্তি বাতিল করতে হবে।
৩. পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী পর্যটনসহ উন্নয়নের নামে অবাধ ও পূর্বাবহিত সম্মতি ব্যতিরেকে অন্যান্য সকল প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অবিলম্বে বন্ধ করে অনুরূপ প্রক্রিয়ায় দখলকৃত সকল ভূমি থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ করা।