চবিতে পিসিপির উদ্যোগে শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের সমাপনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

হিল ভয়েস, ২৭ জুন ২০২৫, চট্টগ্রাম: গতকাল ২৬ জুন ২০২৫ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জুয়েল চাকমা। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইফাজ উদ্দীন আহমেদ ইমু, রঁদেভু শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সভাপতি ভূবন চাকমা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধন রঞ্জন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, চবি কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শৈমং সাইন মারমা। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন টুর্নামেন্ট আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক উচিংক্য চাকমা।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে ফেরার পথে বাসের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় রাঙ্গামাটির কল্যাণপুরস্থ পেট্রোল পাম্পের সামনে চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ কর্তৃক গ্রেনেড হামলায় সুইডিশ পলিটেকনিকের ছাত্র মংচসিং মারমাসহ অপরাপর ছাত্ররা গুরুতরভাবে আহত হয়। পরদিন চমেক হাসপাতালে মংচসিং মারমা মৃত্যুবরণ করেন। নিভে যায় সম্ভাবনাময় এক তরুণের জীবন প্রদীপ। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরও অনেকে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জুয়েল চাকমা বলেন, শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র নেতৃত্বকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নানা উপায়ে হীন ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এরকমই এক হীন ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী, চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের ছোঁড়া গ্রেনেডে গুরুতর আহত ও পরে নিহত হন ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা।

তিনি বলেন, জুম্ম জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে জনসংহতি সমিতি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে ও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজকে সেই জনসংহতি সমিতিকে নিয়ে চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠী ও শাসকগোষ্ঠী নানা উপায়ে দেশে ও বিদেশে অপপ্রচার করে যাচ্ছে এবং জুম্ম জনগণের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা ছাত্র সমাজের আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয়ার চেষ্টা করছে।

তিনি আরও বলেন, আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো একক জাতিগোষ্ঠী বা সংগঠন জনগণের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সেজন্য আমাদের আরও অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তি পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বহুবার সে চেষ্টা করেছে ও করে যাচ্ছে। জনসংহতি সমিতি এমনকি চুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফের সাথেও আলোচনার টেবিলে বসেছে জনগণের আন্দোলনকে আরও ঐক্যবদ্ধ ও সুদৃঢ়করণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা সে জায়গায় সম্মত হতে পারেনি। তারাই আবার আজকে ছাত্র সমাজকে তথাকথিত এগত্তরের নামে বিভ্রান্ত করছে। কাজেই আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ছাত্র সমাজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও বাস্তবতা নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানী হতে হবে এবং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে জনগণের সত্যিকারের বন্ধুকে চিনে নিতে হবে।

পিসিপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুপ্রিয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সমগ্র দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র স্বাধীনতার এত বছর পরও আপন করে নিতে পারেনি। আজকে সমতলের আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে, নানা ভাবে শোষণ অত্যাচার করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে আমরা আরও ভয়াবহ বাস্তবতা দেখতে পাচ্ছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্র সমাজকে আরও অধিকতরভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা ২০১২ সালে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলায় শহীদ হন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে ধ্বংস করতে চুক্তি পক্ষকে ধ্বংস করতে শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠী এভাবেই নানা হীন কর্মকাণ্ড চালায়। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনা ঘটার পরও আমরা দেখতে পাই, ইউপিডিএফ কাদের জন্য কাজ করে। জুম্ম ছাত্র সমাজকে তাই উপলব্ধি করতে হবে এবং চুক্তি বাস্তবায়নের বৃহত্তর আন্দোলনে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইফাজ উদ্দীন আহমেদ ইমু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর রাষ্ট্রযন্ত্র শোষণ নিপীড়ন জারি রেখেছে। আদিবাসী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এই সকল কার্যক্রমকে রুখে দিতে আদিবাসী সচেতন ছাত্র সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।

রঁদেভু শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সভাপতি ভূবন চাকমা বলেন, শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট আমাদের শেকড় নিয়ে, পাহাড় নিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। মংচসিং মারমা জুম্ম জনগণের অধিকারের জন্য লড়তে গিয়ে জীবন দিয়ে আমাদের সেই প্রেরণা দিয়েছেন যে প্রেরণা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সমাজের জন্য বেড়ে উঠতে উৎসাহ যোগায়।

ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধন রঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট চবি’র আদিবাসী শিক্ষার্থীদের একটি মিলনক্ষেত্র। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বন্ধন সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার এই আয়োজন প্রশংসার দাবিদার। পিসিপির এমন উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক।

বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, চবি কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শৈমং সাইন মারমা বলেন, শহীদ ছাত্রনেতা মংচসিং মারমা স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট চবির আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্ব বোধ ও সৌহার্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি শহীদ মংচসিং মারমাকে স্মরণের ও জুম্ম ছাত্র সমাজের আত্মোপলব্ধি করারও একটি উপলক্ষ। জুম্ম জনগণের আন্দোলনে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়া মংচসিং মারমারা তাই আমাদের গর্ব।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমার সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা।

বিগত ১৫ জুন থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ ১১ দিন ব্যাপী টুর্নামেন্টে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মোট আটটি দল অংশগ্রহণ করে। টুর্নামেন্টের ফাইনালে মুখোমুখি হয় টিম চ্যালেঞ্জার্স(২০-২১) ও টিম হিল গ্ল্যাডিয়েটর্স(২২-২৩) এবং ম্যাচে ৫-২ গোলের ব্যবধানে জয় লাভ করে টিম হিল গ্ল্যাডিয়েটর্স।

উক্ত ফাইনাল ম্যাচে ম্যাচ সেরা ও টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার লাভ করেন হিল গ্ল্যাডিয়েটরসের আথুইমং মারমা, টুর্নামেন্টের সেরা গোল রক্ষক নির্বাচিত হন হিল গ্ল্যাডিয়েটরসের বেনদিকার বম এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন চ্যালেঞ্জার্সের আকাশ ত্রিপুরা।

More From Author